কনডেমড সেলে আসামি না রাখতে দেওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন শুনানিতে কে কী বললেন

সুপ্রিম কোর্টফাইল ছবি

বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেমড সেল) রাখা যাবে না বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আগামী ২৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে আজ বুধবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এ আদেশ দেন।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, ‘বন্দীরা (কনডেমড সেলে থাকা বন্দী) এখন বলছেন, আমাদের বের করে নিয়ে যাও, এখানে রাখতে পারবা না। এখানে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, দেখেই এসেছি।’ অন্যদিকে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, হাইকোর্ট কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা আপিল বিভাগ পর্যালোচনা করবেন। এ জন্য পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রয়োজন। রায় না দেখে কী পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি নয়, তা বলা যাবে না। প্রশাসনিক সমস্যা তৈরি হলে সে ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা দেওয়া যেতে পারে।

তিন বছর আগে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ, ঘোষণা, নির্দেশনাসহ সোমবার ওই রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ গতকাল মঙ্গলবার আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করে, যা আজ চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন শিশির মনির।

‘সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, দেখেই এসেছি’

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, হাইকোর্টের রায়ে অনেকগুলো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে পত্রিকায় এসেছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হবে না ও জামিন দিতেও বলা হয়েছে। স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদনটি করা হয়েছে।

আদালত বলেন, ‘হাইকোর্ট কি নির্দেশনা দিতে পারেন না?’ তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘পারেন কি না, সেটি আপনারা (আপিল বিভাগ) দেখবেন। হাইকোর্ট রুলের ইস্যু আদেশের বাইরে গিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন।’

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ঘোষণা-পর্যবেক্ষণসহ হাইকোর্ট রুল নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় ছাড়া এসবের কার্যকারিতা নেই। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এ পর্যায়ে রায় স্থগিতের কোনো উপাদান নেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘রায়ের পর জেলে কী হচ্ছে, বলছি না। বন্দীরা (কনডেমড সেল থাকা) এখন বলছেন, আমাদের বের করে নিয়ে যাও, এখানে রাখতে পারবা না। এটা না হলে প্রয়োজন ছিল না এখানে আসার। এখানে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, দেখেই এসেছি।’ একটি পত্রিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগ কতটুকু দিতে পারেন, তা আপনারা (আপিল বিভাগ) দেখবেন।’

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, প্রিজনার্স অ্যাক্টের ৩০ ধারার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে রায়ে। এ-সংক্রান্ত ৩০ ধারা হাইকোর্ট বাতিল করেননি। হাইকোর্ট কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা আপিল বিভাগ পর্যালোচনা করবেন। এ জন্য পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রয়োজন। রায় না দেখে কী পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি নয়, তা বলা যাবে না। প্রশাসনিক সমস্যা হলে সে ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা দেওয়া যেতে পারে।

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘রায় স্থগিত হলে উনি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? আপত্তি দিচ্ছেন, উদ্দেশ্যটা কী? উনি যা বলতে চাচ্ছেন, তার মানে উদ্দেশ্য আছে, উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন।’

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘যদি কোনো উদ্দশ্য থাকে, সে ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা দেওয়া যেতে পারে। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণগুলো আদালতের সামনে নেই। পর্যবেক্ষণগুলো দেখিনি, এগুলো কীভাবে স্থগিত হয়?’

‘ডেথ সেল বানাল কে’

শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, ডেথ সেল বানাল কে? কোন আমলে? তখন শিশির মনির বলেন, জেল কোড, ব্রিটিশ আমলে।

আদালত বলেন, ‘এরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য জাতি বলে আমরা মনে করি। কথায় কথায় এদের ফলো করি। বানিয়েছিল সব এরাই এবং সবকিছু করেছে তারা। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সলিডারিটি কনফাইনমেন্ট—এটা করল কারা?’

তখন শিশির মনির বলেন, ‘যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের বানানো থিওরি থেকে সরে এসেছেন। অথচ আমরা তাঁদের অনুসরণ করে যাচ্ছি। এগুলো কী মূল্যায়ন করতে হবে না ? বলে হয়েছে, আমার উদ্দেশ্য আছে, যদি আমার উদ্দেশ্য থেকে থাকে, তাহলে আদালত স্থিতাবস্থার আদেশ দিতে পারেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, স্থগিতাদেশ না দেওয়া হলে রায়ের পর চলমান কার্যক্রম বেআইনি হয়ে যাবে। তাই স্থগিতাদেশ প্রয়োজন। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন আপিল বিভাগ।

শুনানি নিয়ে আদালত বলেন, আগামী ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রায় স্থগিত করা হলো। সেদিন শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হলো। এই সময়ের মধ্যে সিপি (লিভ টু আপিল) করতে বলা হলো।

বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিত আসামিকে কনডেমড সেলে রাখার বৈধতা নিয়ে ২০২১ সালে রিটটি হয়। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে কনডেমড সেলে থাকা তিন আসামি রিটটি করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল দেন। এই রুল নিষ্পত্তি করে সোমবার হাইকোর্ট রায় দেন।

বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেম সেল হিসেবে পরিচিত) রাখা যাবে না বলে রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট। ঘোষিত রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে অন্য বন্দীদের মতোই দেখতে হবে। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বা অন্য বন্দীদের নিরাপত্তার স্বার্থে, সংক্রামক রোগ, স্বাস্থ্যগত বিষয়সহ ব্যতিক্রম পরিস্থিতির কারণে তাঁকে কনডেমড সেলে রাখতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর বক্তব্য শুনতে হবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের সাধারণ সেলে স্থানান্তরের জন্য অবকাঠামো ব্যবস্থাসহ উদ্যোগ শুরু করতে কারা কর্তৃপক্ষে নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালত বলেন, তবে তা দুই বছরের বেশি সময় নয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিনের নজির দেখা যায় না উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী জামিন আবেদন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগের জামিন আবেদন গ্রহণ করা উচিত।