চার ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দৃঢ় সহায়তার প্রত্যয় সি চিন পিংয়ের

সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ (মাঝে), প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান (বাঁয়ে) ও প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানছবি : সংগৃহীত

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সুবিধার প্যাকেজ ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দৃঢ় সহায়তা দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

গতকাল বুধবার বিকেলে বেইজিংয়ের গ্রেট হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সি চিন পিং বাংলাদেশকে গ্রান্ট বা সহায়তা, সুদমুক্ত ঋণ, কনসেশনাল বা ছাড়যুক্ত ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ—এই চার ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধার একটি প্যাকেজ দেওয়ার ঘোষণা দেন।

সেই সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট নিজে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলেন। তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে এবং প্রয়োজনে আরাকান সেনাদলের সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানান।

বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেইজিংয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্টের এসব ঘোষণার কথা জানান। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ও প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিবৃতিতে এসব জানিয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর শতভাগ সফল হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট বৈঠকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নকে অভূতপূর্ব বর্ণনা করেছেন এবং চীনা সহায়তা অব্যাহত  থাকবে বলে জানান। সি চিন পিং জানান, ২০২৫ সালে চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে সম্পর্ককে দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত করে এ উদ্‌যাপনকে অর্থবহ করতে তাঁরা প্রস্তুত।

চীনের প্রেসিডেন্ট ‘গুড গভর্ন্যান্স নিডস গুড পার্টি’ বা ‘সুশাসনের জন্য ভালো দল’ মন্তব্য করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যোগাযোগ বৃদ্ধি ও বন্ধনের ওপর জোর দেন বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পাশাপাশি সি চিন পিং বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ, কারিগরি, কৃষি ও উৎপাদন খাতে সহায়তা ও শিক্ষার্থী বৃত্তি বৃদ্ধির আশ্বাস দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনের জন্য একক বরাদ্দ ৮০০ একর জমিসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইটি ভিলেজগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ থেকে পাট ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিক, আম ও অন্যান্য ফলসহ পণ্য আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার আহ্বান জানালে চীনের প্রেসিডেন্ট ইতিবাচক সাড়া দেন।

এদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিংয়ের গ্রেট হলে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলসহ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন।

এরপর দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করেন। পাশাপাশি চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ইউয়ান (আরএমবি) সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। পরে বেইজিংয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের উপস্থিতিতে ২২তম সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সম্মানে গ্রেট হলে আয়োজিত চীনের রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন। ১১ জুলাই সকালের পরিবর্তে ১০ জুলাই রাতে প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং ত্যাগ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ বেশি অসুস্থ হওয়ায় চীন সফরের সব অনুষ্ঠান অপরিবর্তিত রেখে শুধু ১১ তারিখ সকালের পরিবর্তে ১০ জুলাই রাতে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব, সচিববৃন্দসহ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানমালায় যোগ দেন।

বেইজিংয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের উপস্থিতিতে চীনের শ্যানডং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরের সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জসিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্মারকগুলো—

১. ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে সমঝোতা
২. চায়না ন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রেগুলেটরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনএফআরএ), বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংকিং ও বিমা নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সমঝোতা
৩. বাংলাদেশ থেকে চীনে তাজা আম রপ্তানির জন্য উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত (ফাইটোস্যানিটারি)  উপকরণ বিষয়ে প্রটোকল
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি সহায়তা ক্ষেত্রে সমঝোতা
৫. বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়তা সমঝোতা
৬. বাংলাদেশে প্রকল্পে চায়না-এইড ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের ‘সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ বিষয়ে আলোচনার কার্যবিবরণী
৭. চীনের সহায়তায় ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতু সংস্কার প্রকল্পপত্র বিনিময়
৮. নাটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা পার্ক প্রকল্পে চায়না-এইড কনস্ট্রাকশনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষাপত্র বিনিময়
৯. চীনের সহায়তায় নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্পপত্র বিনিময়
১০. মেডিকেল সেবা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সহযোগিতা শক্তিশালীকরণ সমঝোতা
১১. অবকাঠামোগত সহযোগিতা জোরদারে সমঝোতা
১২. গ্রিন অ্যান্ড লো-কার্বন উন্নয়ন বিষয়ে সহযোগিতা
১৩. বন্যার মৌসুমে ইয়ালুজাংবু (ব্রহ্মপুত্র) নদীর হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য বাংলাদেশকে দেওয়ার বিধিবিষয়ক সমঝোতা স্মারক নবায়ন
১৪. চীনের জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন প্রশাসন এবং বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা
১৫. চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা
১৬. চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) ও বিটিভির মধ্যে সমঝোতা
১৭. সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি ও বিটিভির মধ্যে সমঝোতা
১৮. চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া ও বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের মধ্যে সমঝোতা
১৯. সিনহুয়া সংবাদ সংস্থা ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের মধ্যে সমঝোতা
২০. চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক নবায়ন
২১. টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিষয়ে সমঝোতা
২২. চীনের শ্যানডং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা
ঘোষণাপত্র—
১.  চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সমাপ্তি ঘোষণা
২.  চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি ত্বরান্বিত করা নিয়ে আলোচনা শুরুর ঘোষণা
৩.  ডিজিটাল কানেকটিভিটি প্রকল্পের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণের সমাপ্তির ঘোষণা
৪.  ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের সঙ্গে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের ট্রায়াল রান সমাপ্তির ঘোষণা
৫.  রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালুর ঘোষণা
৬.  বাংলাদেশে লুবান ওয়ার্কশপ নির্মাণের ঘোষণা
৭. চীনের শ্যানডং অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতার ঘোষণা

সংশোধনী: গতকাল বুধবার প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার প্রথম সংস্করণে ‘চীন ১০০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দেবে’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। বুধবার বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আলোচনা এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বরাত দিয়ে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছিল, চীন ১০০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দেবে। তবে পরে বুধবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সহায়তার পরিমাণ ১০০ কোটি ইউয়ানের (আরএমবি) কথা জানানো হয়। তার ভিত্তিতে প্রথম আলো পত্রিকার নগর সংস্করণে ‘চীন ১০০ কোটি ইউয়ান আর্থিক সহায়তা দেবে’ শিরোনামে খবরটি প্রকাশ করা হয়।