জাতীয় ডিএনএ ল্যাবের কাজ বন্ধ

এনএফডিপিএলের ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট

তিন মাস ধরে জাতীয় ডিএনএ ল্যাব হিসেবে পরিচিত ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির (এনএফডিপিএল) কর্মীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিএনএ পিসিআর কিট না থাকায় ২৭ অক্টোবর থেকে ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো মামলার আলামতগুলোর স্তূপ তৈরি হচ্ছে। এতে বিচারাধীন মামলায় প্রভাব পড়ছে।

ভুক্তভোগীদেরও বিচার পেতে বিলম্ব হচ্ছে। ল্যাবের ভেতর আলামত সংরক্ষণের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় আলামত নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে।

অবশ্য ল্যাবের এ অচলাবস্থা এবারই প্রথম নয়। ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত জেনেটিক অ্যানালাইজার মেশিনের যন্ত্রাংশ নষ্ট থাকায় ল্যাবের কাজ বন্ধ ছিল। ল্যাবের গত দুই বছরের হিসাব বলছে, ১ হাজার ৪৫৬টি মামলায় ডিএনএ টেস্টের জন্য আলামত ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪০৪টি মামলাই ধর্ষণের মামলা। দুই বছরের মোট মামলাগুলোর মধ্যে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ডিএনএ প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৪৯৬টি, ঝুলে আছে ৯৬০টি।

ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ২০২০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর সংশোধিত আইনে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী ব্যক্তির সম্মতি না থাকলেও ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ শিরোনামের প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনে এনএফডিপিএল প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রকল্পের আওতায় আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়।

প্রকল্পের চতুর্থ পর্বের দ্বিতীয় সংশোধনী মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে। এনএফডিপিএলের ৫৪ জন কর্মী প্রকল্প থেকেই বেতন পাচ্ছেন আর ল্যাব পরিচালনায় যে বাজেট লাগছে তা দিচ্ছে অধিদপ্তর।

জাতীয় ল্যাবের ল্যাব প্রধান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাবেদুল আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, আগামী জুন পর্যন্ত ল্যাবের জন্য ছয়টি পিসিআর কিটের চাহিদার কথা মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। একেকটি কিটের দাম ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। একেকটি কিট দিয়ে ২০০টি আলামত পরীক্ষা করা যায়। কাজ বন্ধ থাকায় ধর্ষণ, টিস্যু ট্রান্সপ্ল্যান্টের মতো ঘটনায় পুলিশ বারবার প্রতিবেদনের জন্য তাগাদা দিচ্ছে। ধর্ষণের কিছু মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিএনএ ল্যাবে স্থানান্তর করার জন্য মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা আবেদন করছেন।

প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ল্যাবের দক্ষ জনবলের কপালে কী ঘটবে কেউ তা জানেন না। কর্মরত ব্যক্তিদের বেতন অনিয়মিত। দুই মেয়াদে প্রায় এক বছরের বেতন বকেয়া আছে। এসব ল্যাবের কাজে প্রভাব ফেলছে।

ল্যাবের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ডিএনএ আইনের অধীনে সিআইডির ল্যাবটি চালু হয় ২০১৪ সালে। ২০১৮ সালে প্রকল্পের জনবলসহ রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করা হয়েছে।

অথচ ২০০৬ সাল থেকে যাত্রা শুরু করা এনএফডিপিএল এ কর্মরতরা এখনো প্রকল্পের অধীনেই রয়ে গেছেন। প্রকল্প থেকে আদৌ রাজস্ব খাতে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে বিদেশ বা দেশেই অন্য চাকরিতে চলে যাচ্ছেন।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাহিদ মঞ্জুরা আফরোজ। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ল্যাবের জনবলের বেতন দেওয়া হচ্ছে প্রকল্প থেকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর ডিএনএ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর খুব দ্রুত কিট কেনার বিষয়টি সুরাহা করে ফেলবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ডিএনএ ল্যাবের কথা ইতিবাচকভাবেই বিভিন্ন জায়গায় ফলাও করে প্রচার করেন। এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা গত বছরের ২১ জুন রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কমনওয়েলথ উইমেন্স ফোরামের দ্বিতীয় দিনের এক আলোচনায় মন্ত্রী বলেছিলেন, সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করায় অপরাধীদের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।

এনএফডিপিএলএ কর্মরতদের ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তা

২০২০ সালের আগস্ট মাস থেকে ডিএনএ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর যাত্রা শুরু করে। কয়েকজন জনবল নিয়ে নামকাওয়াস্তে চলছে অধিদপ্তরের কার্যক্রম। অধিদপ্তর গঠনের পরও যাঁদের হাত ধরে এনএফডিপিএল যাত্রা শুরু করেছিল তাঁদের দক্ষতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ডিএনএ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত নিয়োগ বিধিমালায় তাঁদের বিষয়ে বিশেষ কোনো বিধানও রাখা হয়নি এবং এ বিধিটির খসড়া বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং এর জন্য আছে।

কোনো ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও তার বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নির্ধারণ, ডিএনএ নমুনা ও প্রোফাইলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি স্থাপন, জাতীয় ডিএনএ ডেটাবেজ প্রতিষ্ঠা ও আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে বিধান প্রণয়নের জন্য ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) নামে ২০১৪ সালে সরকার আইন প্রণয়ন করে। অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি, নিখোঁজ বা অজ্ঞাত ব্যক্তি শনাক্তকরণ, দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত ব্যক্তি শনাক্তকরণ, বিরোধ নিষ্পত্তি এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো বিষয়ে ডিএনএ নমুনা ও ডিএনএ প্রোফাইল ব্যবহার করা হচ্ছে।

ডিএনএ আইনেই উল্লেখ আছে, এনএফডিপিএল এই আইনের অধীনে ‘সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত’ হয়েছে বলে গণ্য হবে। আইনের অধীনে অধিদপ্তর গঠন হবে এবং অধিদপ্তর ডিএনএ ল্যাবরেটরি, জাতীয় ডিএনএ ডেটাবেজ প্রতিষ্ঠা এবং এ–সংক্রান্ত কার্যক্রম সমন্বয়, তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণসহ অন্যান্য কাজ করবে। ডিএনএ কার্যক্রমের গুণগত মান বজায় রাখা, ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা, ডিএনএ বিশ্লেষণের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ, সংরক্ষিত তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বজায় রাখার সুষ্ঠু পদ্ধতি অনুসরণ, ডিএনএ পরীক্ষার কারিগরি মান বজায় রাখার জন্য যথাযথ যন্ত্রপাতির ব্যবহারের বিষয়টিও আইনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে।

ল্যাবের বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পটির প্রথম পর্বের প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ল্যাবে কর্মরত জনবল মন্ত্রণালয়ের কাঠামোতে পর্যায়ক্রমে আত্তীকরণ হবে, দ্বিতীয় পর্বের ডিপিপিতে ল্যাবের পদগুলো নিয়মিতকরণ এবং তৃতীয় পর্বের ডিপিপিতে ল্যাবের জনবল রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করা হবে বলে উল্লেখ আছে। তবে বাস্তবে তা হয়নি। প্রকল্পের চতুর্থ পর্বেও প্রকল্পের অধীনেই জনবলকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ৫৪ জনবলের পক্ষে ৪৭ জন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দুটি রিট করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের করা রিট পিটিশনগুলোর রায়ে প্রকল্পের আওতাধীন ল্যাবগুলোতে কর্মরতদের রাজস্ব বাজেটে সব সুবিধাসহ আত্তীকরণ বা নিয়মিতকরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। বর্তমানে রিট দুটির আপিলের শুনানি চলছে।

অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত নিয়োগবিধিতে ল্যাবগুলোর ৫৪টি পদের মধ্যে মাত্র ২৭টি পদের মিল আছে। আইনে ডিএনএ ডেটাবেজ তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এবং এ জন্য অধিদপ্তরের নিয়োগবিধিতেও কোনো পদ রাখা হয়নি।

এনএফডিপিএলের ল্যাব প্রধান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাবেদুল আলম খন্দকার বলেন, ডিএনএ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়োগবিধিতে কর্মীদের যে বয়সের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে ল্যাবে কর্মরতদের খুব বেশি হলে ১০ থেকে ১২ জন পরীক্ষা দিতে পারবেন। তাই কর্মরত ব্যক্তিরা হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনের পর দিন কাজ করছেন।

ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে (অতিরিক্ত) দায়িত্ব পালন করছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আবেদা আকতার। পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুফিয়া নাজিম। এনএফডিপিএলের জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টার পদটি শূন্য। এ পদ থেকে গত বছর অব্যাহতি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক শরীফ আখতারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডিএনএ ল্যাব ও অধিদপ্তর বিশেষায়িত ধরনের টেকনিক্যাল কাজভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালনায় বিজ্ঞানীরা থাকবেন। দক্ষ জনবল লাগবেই। তা না হলে সমস্যা বাড়বে। এ ছাড়া ল্যাবের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল সেই শুরুতে, ওই যন্ত্রপাতি দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে।