এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

শিক্ষক
প্রতীকী ছবি

এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা এখন সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ পান। এই সুযোগ বন্ধে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্যও সুনির্দিষ্ট বিধিমালা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকেরা (ডিসি)। এবারের ডিসি সম্মেলনে এমন প্রস্তাবের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, তাঁরাও মনে করেন, এটি একটি ভালো প্রস্তাব। এ বিষয়ে কাজ করবেন তাঁরা।

তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনের প্রথম দিনে ২৪ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত আলোচনায় ডিসিদের প্রস্তাবে তাৎক্ষণিকভাবেই এমন ইতিবাচক সাড়া দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা। এখন সরকার যদি সরকারি কর্মচারীদের মতো আচরণ বিধিমালা করে, তাহলে দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতি বন্ধ হবে।

ডিসিদের আরেকটি প্রস্তাব ছিল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ করা অর্থে উন্নয়ন প্রকল্পের আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা ডিসিদের দেওয়া। তবে ডিসিদের এই প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আগের মতোই গণপূর্ত বিভাগ বিষয়টি করবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সূত্রগুলো বলেছে, সদ্য শেষ হওয়া তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনে দেওয়া ডিসিদের অনেক প্রস্তাবের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। আবার কিছু প্রস্তাব যেমন নাকচ করা হয়েছে, কোনো প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিবেচনায় নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

২৪ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে ডিসি সম্মেলন। ডিসিরা মাঠ প্রশাসনে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সরাসরি ডিসিদের নানা দিকনির্দেশনা দেন। এ জন্য এই সম্মেলনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। এর মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটাই শেষ ডিসি সম্মেলন হওয়ায় এই সম্মেলন নিয়ে বাড়তি নজর ছিল। শেষ দিনে জাতিকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) তৈরি থাকতে বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে তাঁদের ভূমিকাই প্রাধান্য পাবে, মুখ্য হবে।

তিন দিনের আলোচনার জন্য ডিসিদের পক্ষ থেকে আগেই মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিয়ে মোট ২৪৫টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বৈঠকে অংশ নেওয়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ডিসিদের প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে আগেই প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যার যার সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো পাঠানো হয়েছিল। সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক আলোচনায় মন্ত্রী-সচিবদের পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাবের বিষয়ে তাদের অবস্থান জানানো হয়। কেউ কেউ হয়তো কোনো কোনো প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন। কেউ কেউ হয়তো বলেছেন কোনো কোনো প্রস্তাব তাদের রুলস অব বিজনেসে পড়ে না। আবার বাজেট সমস্যার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবের বিপরীতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত স্বল্পমেয়াদি, কিছু মধ্যমমেয়াদি এবং কিছু দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়িত হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এখন সিদ্ধান্তগুলো কতটা বাস্তবায়িত হলো, সে বিষয়ে ফলোআপ করা হবে। প্রায় প্রতি মাসেই বিষয়টি ফলোআপ করা হবে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের রাজনীতি

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সূত্রমতে, দেশের প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। বর্তমানে সারা দেশে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীন ২০ হাজার ২৭৭টি এমপিওভুক্ত স্কুল ও কলেজ আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৮ জন। এ ছাড়া ২ হাজার ১৩৮টি এমপিওভুক্ত কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০ হাজারের বেশি শিক্ষক সরকার থেকে মূল বেতন পান। আরও দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান নতুন করে এমপিওভুক্ত হয়েছে। তবে এখনো এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে মূল বেতন পাওয়া শুরু করেননি। এ ছাড়া সারা দেশে এমপিওভুক্ত ৮ হাজার ২২৮টি মাদ্রাসা আছে। এগুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা ১ লাখ ৬৪ হাজার।

এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা এখন মূল বেতনের পুরোটা সরকার থেকে পান। এর সঙ্গে সামান্য কিছু ভাতা দেওয়া হয় তাঁদের। তবে বেসরকারি হওয়ায় তাঁরা সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ পান।

ডিসিদের পক্ষ থেকে দেওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আচরণবিধিমালা করার প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছিল, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে পাঠদান কার্যক্রমে তাঁদের দায়সারা আচরণ দেখা যায়। বিধিমালা বা নীতিমালা থাকলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করাও সম্ভব।

বিষয়টিকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, এটা করলে বরং বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরকারীকরণের দাবি আরও পোক্ত হবে। তিনি মনে করেন, এটি হওয়া উচিত।

ডিসিদের এই প্রস্তাবের বিষয়ে প্রথম আলোর অনলাইনে মতামত চাওয়া হয়েছিল। তাতে ভোটদাতা ছিলেন ২ হাজার ১৫৬ জন। তার মধ্যে ৯৪ শতাংশই ওই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

তবে বেসরকারি শিক্ষকদের সংগঠনের নেতারা মনে করেন, এটা তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের শামিল। তাঁদের বক্তব্য হলো, তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী সরকার আগে তাঁদের চাকরি জাতীয়করণ করুক। এরপর যদি সরকারি চাকরিজীবীদের মতো বিধিমালা করে, তাহলে তাঁদের আপত্তি থাকার সুযোগ থাকবে না।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রবীণ শিক্ষকনেতা কাজী ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইউনেসকো শিক্ষকদের রাজনীতির অধিকারের কথা বলেছে। সুতরাং শিক্ষকদের আদর্শিক রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে। তবে অধিকার ভোগ করতে হলে শিক্ষকদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। একজন শিক্ষক রাজনীতি করেন, সেই শিক্ষক ক্লাসে যাওয়ার পর যদি শিক্ষার্থীরা তাঁকে দেখে বের হয়ে যায়, তাহলে তো হবে না। তাঁকে আদর্শিক হতে হবে। সুতরাং আচরণবিধি করতে অসুবিধা নেই। তবে সেটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় না জাতীয়করণ করা হলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তবে এটি সিদ্ধান্তের বিষয়।’

অবশ্য শিক্ষা বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হলেও আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

অন্য প্রস্তাবের বিষয়ে কী হচ্ছে

ডিসিদের দেওয়া ২৪ ঘণ্টার জন্য ‘শিক্ষা চ্যানেল’ করার প্রস্তাবকেও যৌক্তিক মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী। অবশ্য মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নামে স্বতন্ত্র অধিদপ্তর করার প্রস্তাবের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বিমত প্রকাশ করেছে।

এবার ডিসিদের পক্ষ থেকে সীমান্তের আট কিলোমিটারের বাইরে বিজিবি সদস্যের মাধ্যমে গুলির ঘটনা ঘটলে নির্বাহী তদন্তের মাধ্যমে যৌক্তিকতা যাচাই করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন খাগড়াছড়ির ডিসি। এ ছাড়া দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারা ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের তফসিলভুক্ত করারও প্রস্তাব এসেছিল ডিসি সম্মেলনে।

আরও পড়ুন

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এসব প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিবেচনা করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
গতানুগতিক প্রস্তাবের বাইরেও এ বছরের সম্মেলনে ডিসিদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছিল। তার মধ্যে ছিল উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গণিত ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজন করা এবং এসব অলিম্পিয়াড থেকে লব্ধ জ্ঞান আরও গবেষণার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া। পর্যায়ক্রমে সব উপজেলায় পাবলিক লাইব্রেরি নির্মাণ করতে বলেছেন ভোলার ডিসি।

এ ছাড়া কারাগারে বন্দীদের সাক্ষাতের সুবিধার্থে ভিডিও কলের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ডিসিরা। একই সঙ্গে কারাগারের সাক্ষাৎকক্ষে স্বচ্ছ গ্লাসের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে ইন্টারকমের মাধ্যমে কথা বলার ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডিসিরা।

অবশ্য ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা বলার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা আছে বলে মনে করেন সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খান।

এবার বিভিন্ন এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সরকার মনে করে, ইতিমধ্যে অনেকগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়েছে। সেখানে এখনো অনেক জায়গা খালি আছে। তাই আগে দেখতে হবে সেই অর্থনৈতিক অঞ্চল সেই এলাকায় আসলে কতটা ভালো হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে গেলে কৃষিজমি আর নষ্ট করা যাবে না। সেটা খাসজমিও যদি কৃষিজাত হয়, করতে হলে অকৃষি জমিতে করতে হবে।

আরও পড়ুন