মাদকসেবীদের অপরাধী হিসেবে নয়, রোগী হিসেবে দেখলে চিকিৎসা সহজ

শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান: সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’ শীর্ষক এক মুক্ত সংলাপে আলোচকেরাছবি: প্রথম আলো

মাদকসেবীদের অপরাধী নয়, রোগী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। তাহলে তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পথ সহজ হবে। মাদকের বিরুদ্ধে শিশু, কিশোর ও তরুণদের দৃঢ় মানসিক শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব হলে তাদের মাদক থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এর পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সঠিক আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। এভাবে সবার সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমেই দেশকে মাদকমুক্ত করা সম্ভব।

‘শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান: সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’ শীর্ষক এক মুক্ত সংলাপে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস ২০২৫ উপলক্ষে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে এই মুক্ত সংলাপের আয়োজন করা হয়।

আলোচনায় উঠে এসেছে, ১০ বছরের কম বয়সী শিশুরাও মাদকে আসক্ত হচ্ছে। মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহমেদ হেলাল সাড়ে ৯ বছর বয়সী একটি শিশুর চিকিৎসা করেছেন উল্লেখ করে বলেন, শিশুটি ঢাকার একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। শুধু মাদকাসক্ত নয়, সে মাদক বিক্রিও করত। তার কাছে ১৫–১৬টি মুঠোফোনের সিম পাওয়া গেছে। এ শিশুকে অপরাধী বলা যাবে না। এটা একটা রোগ। তার চিকিৎসা করাতে হবে। মাদক থেকে দূরে রাখতে শিশুদের দৃঢ় মানসিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষকদেরও ভূমিকা থাকতে হবে।

মাদক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাসান মারুফ বলেন, মাদক প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে আত্মসমালোচনা পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। কারণ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শুধু আইন প্রয়োগ করতে পারে; কিন্তু মূল পরিবর্তনটা আসতে হবে পরিবার থেকে।

বক্তব্য দিচ্ছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাসান মারুফ। পাশেই অভিনেতা আফজাল হোসেন।
ছবি: প্রথম আলো

মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকারও শিশুদের দৃঢ় মানসিক শক্তি গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভূমিকা হচ্ছে অভিভাবকের। যে শিশুর আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি যত বেশি, তার ক্ষেত্রে মাদকের ঝুঁকি অনেক কম। এ জন্য শিশুদের সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তারা যত বেশি খেলাধুলা করবে, তাদের আত্মবিশ্বাস তত বাড়বে। এ ক্ষেত্রে স্কুলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। শিশুরা অনেক সময় ছোট ছোট মানসিক রোগ থেকেও মাদকে আসক্ত হয়।

মাদকসহ নানা আধিপত্যের মূলে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে না থাকা একটি বড় কারণ হিসেবে মনে করেন অভিনেতা আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, মাদক হোক বা অন্য কিছু হোক, সব ক্ষেত্রেই আত্মনিয়ন্ত্রণ করা জানতে হয়।

যারা মাদকাসক্ত হয়, তারা জীবনে অনেক সুযোগ হারায় বলে মনে করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশন) নিশাত সুলতানা। তিনি বলেন, একজন মানুষকে কর্মক্ষম এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে। দেশে মাদকের চাহিদা, সরবরাহ এবং ক্ষতি কমানোর ক্ষেত্রে নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদক দূর করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।

নারীদের মধ্যেও মাদকাসক্তের প্রবণতা বাড়ছে জানিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, এটা নারীদের জন্য অন্য রকম চ্যালেঞ্জ। একজন নারী যখন মাদক নেন, তখন বন্ধ্যত্ব, সন্তানের বিকলাঙ্গ এবং মাদকাসক্ত সন্তানের জন্মদানের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার

ইউনিট্রেন্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ক্রিয়েটিভ চিফ মুনির আহমদ খান বলেন, দেশে মাদক এখন ক্যানসারের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মাদক বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সীমান্ত, যেখান দিয়ে অবৈধভাবে দেশে মাদক আসে। সীমান্তে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের অনেকেই মাদক পাচারকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। এটি রোধ করতে হলে সীমান্তে দায়িত্ব পালনকারীদের নিয়মিত বদলি করতে হবে।

বক্তব্য দেন মডেল ও অভিনেতা আদিল হোসেন নোবেল
ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আশিক সাঈদ বলেন, এটা সত্যি যে সীমান্ত এলাকায় একই কর্মকর্তা বছরের পর বছর দায়িত্ব পালন করলে তিনি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এ জন্য ছয় থেকে আট মাসের বেশি কাউকে সীমান্ত এলাকায় রাখা হয় না। তাঁদের বদলি করে নতুনদের পাঠানো হয়।

মাদকের পৃষ্ঠপোষকদের ধরা যাচ্ছে না উল্লেখ করে আশিক সাঈদ বলেন, মাদকসেবী ও মাদক পরিবহনকারীদের বিরুদ্ধেই শুধু মামলা হচ্ছে এবং তাঁদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে; কিন্তু পৃষ্ঠপোষকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন।

মুক্ত সংলাপ সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। আরও বক্তব্য দেন মডেল ও অভিনেতা আদিল হোসেন নোবেল, সাবেক টেবিল টেনিস তারকা জোবেরা রহমান লিনু, সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা, ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ফ্লোরেন্স গোমেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল পলাশ, সিটি ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ফারিয়া রাব্বী, উত্তরা ইউনিভার্সিটির স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের ডিন শাহ আহমেদ, সাউথ ব্রিজ স্কুলের উত্তরা ব্রাঞ্চের শিক্ষক রেহানা আক্তার, আপন নিবাসের কাউন্সিলর খন্দকার আসাদুজ্জামান জুয়েল, মিশন গ্রিন বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আহসান রনি, ভ্রমণকন্যার প্রতিষ্ঠাতা সাকিয়া হক ও মানসী সাহা, কাশফুল ফাউন্ডেশনের ফারহানা ইসলাম, হিমু পরিবহনের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি মাহমুদা মহসিনা ও উপদেষ্টা দীপ্তি সরকার এবং কিশোর আলোর কন্ট্রিবিউটর রেজওয়ানা পুষ্প।