যেভাবে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি সায়েম

সাবেক প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন দেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। একই সঙ্গে ছিলেন সামরিক শাসনকালের বেসামরিক রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের সময়ে তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এক বছর পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি তিনি হারান। আর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট পদ থেকেও পদত্যাগ করেন। তিনি বলেছিলেন, ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আসলেই কি তা-ই? সেই ঘটনার আদ্যোপান্ত জানা যাক তাহলে।  

১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। পদত্যাগ করলেন দেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তিনি ছিলেন সামরিক শাসনের বেসামরিক রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদ পদত্যাগ করলে ৬ নভেম্বর আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন, আর ৮ নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসকও (সিএমএলএ) ছিলেন। যদিও ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর এই পদটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

যেভাবে তিনি রাষ্ট্রপতি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে ক্ষমতায় আসেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তবে অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশেষ করে ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনায় তাঁর পদে থাকার আর কোনো উপায় ছিল না। সময়টা ছিল মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময়।

মওদুদ আহমদ ‘গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন’ বইতে এ নিয়ে লিখেছেন,

‘৫ নভেম্বর মধ্যরাতে মোশতাক তাঁর ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বিদায়ের আগে তিনি একটি সামরিক আইন অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করে যান। এই অধ্যাদেশে বলা হয় যে রাষ্ট্রপতি তাঁর উত্তরসূরি নিয়োগ করে পদত্যাগ করতে পারবেন। সঙ্গে সঙ্গে খালেদ এবং তাঁর অফিসাররা কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এম সায়েমকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসেন এবং পরদিন তাঁকে দেশের নয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন।

অফিসাররা প্রথমে চিন্তা করছিলেন যে তাঁরা খালেদ মোশাররফকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করে সায়েমকে নামমাত্র রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল রাখবেন। কিন্তু পরে খালেদ স্থির করেন যে সায়েম একাধারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হবেন এবং দেশ পরিচালনার জন্য ১০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ গঠন করবেন। পরিষদের সব সদস্যই নির্বাচিত হবেন সশস্ত্র বাহিনী থেকে এবং সায়েম শুধু তাঁর নামমাত্র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।’

কুদ্দুস চৌধুরী বললেন, ‘প্রধান বিচারপতি কীভাবে রাষ্ট্রপতি হবেন? সংবিধানে এমন বিধান তো নেই।’ জবাবে আমি বললাম, ‘যেভাবে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছেন, সেভাবেই চিফ জাস্টিসকে ওখানে বসিয়ে দিন। আপনিই তো হরফুন মওলা।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা। সাবেক মন্ত্রী, বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমদ এই দলে ছিলেন। ‘সৈনিক জীবন, গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর’ বইটিতে তিনি প্রধান বিচারপতি সায়েমের রাষ্ট্রপতি হওয়ার দিনটি নিয়ে একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,

‘বেলা দেড়টার দিকে কনফারেন্স রুমে এলেন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কুদ্দুস চৌধুরী (পরবর্তীকালে বিচারপতি)। তিনি অত্যন্ত ঝানু ব্যক্তি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানে যতগুলো সংশোধনী আনা হয়েছে, যেমন ইমার্জেন্সি, মার্শাল ল প্রোক্লেমেশন ইত্যাদি, সব কটিই তাঁর কলম থেকে এসেছে। কুদ্দুস চৌধুরী বললেন, ‘প্রধান বিচারপতি কীভাবে রাষ্ট্রপতি হবেন? সংবিধানে এমন বিধান তো নেই।’ জবাবে আমি বললাম, ‘যেভাবে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছেন, সেভাবেই চিফ জাস্টিসকে ওখানে বসিয়ে দিন। আপনিই তো হরফুন মওলা। একটু হেসে তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাষণে একটি প্যারা যোগ করে আইনিপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করলেন।’

অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে অন্যতম কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.) রাষ্ট্রপতি হওয়ার অনুরোধ নিয়ে আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের বাসভবনে গিয়েছিলেন। ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্যে-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ নামের বইয়ে তিনি সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। শাফায়াত জামিল লিখেছেন,

‘৫ নভেম্বর সন্ধ্যায়ই আমরা বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যাতেই খালেদ মোশাররফ, এম জে তাওয়াব এবং এম এইচ খানসহ আমরা বিচারপতি সায়েমের বাসভবনে গেলাম। সায়েম ধৈর্যসহকারে খালেদের বক্তব্য শুনলেন। এর আগে অবশ্য তাঁকে একবার বঙ্গভবনে ডেকে এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথাটি জানানো হয়েছিল। যাহোক, সায়েম এখন খালেদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি পেয়ে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেন। আমরা কিছুটা পীড়াপীড়ি করায় বললেন, পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিচারপতি সায়েম তক্ষুনি উঠে গিয়ে ঘরের ভেতরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এলেন তিনি। এত তাড়াতাড়ি যে আমাদের মনে হলো যেন এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ঢুকলেন তিনি! এ সময়ের মধ্যে কার সঙ্গে কী আলাপ করলেন, তা তিনিই জানেন। তো, সায়েম এসেই বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

এরপরই ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিদ্রোহের ঘটনার মধ্য দিয়ে দৃশ্যপটে চলে এসেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। খালেদ মোশাররফ নিহত হলে সেনাপ্রধান হন জিয়াউর রহমান। সামরিক শাসন আগেই জারি করা ছিল। সে সময় তিন বাহিনীর তিন প্রধান ছিলেন উপ সামরিক আইন প্রশাসক (ডিসিএমএলও)।

দৈনিক বাংলা, ৬ নভেম্বর, ১৯৭৫
সৌজন্য: সংগ্রামের নোটবুক

যেভাবে সিএমএলের পদ থেকে বিদায়

আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করা। কিন্তু তিনি সেটা করতে পারেননি। কারণ এক এক করে তার ডানা ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। ‘বিএনপি: সময়-অসময়’ বইয়ে এর একটি বিবরণ দিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি লিখেছেন,

‘জিয়া উপলব্ধি করলেন, বিচারপতি সায়েম একাধারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে থাকলে তাঁর (জিয়ার) জন্য এটা বিপজ্জনক হতে পারে। সায়েম হয়তো আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করবেন। জিয়ার আকাঙ্ক্ষায় ক্রমেই ডালপালা গজাচ্ছিল। নির্বাচন হয়ে গেলে তাঁর স্বপ্ন এখানেই খান খান হয়ে যেতে পারে। জিয়াকে সরিয়ে অন্য কাউকে সায়েম সেনাপ্রধান নিয়োগ করতে পারেন, এ রকম একটা কানাঘুষাও ছিল। জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, সায়েমকে মাটিতে নামিয়ে আনতে হবে। ২৮ নভেম্বর তিনি বঙ্গভবনে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর, নবম পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদকে। রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী বিচারপতি আবদুস সাত্তারও ওই সময় বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন। জিয়া রাষ্ট্রপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দিতে বললেন।

সায়েম রাজি হলেন না। তাঁর কথা হলো, ‘আমি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়েছি, দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার কাজ আমাকে শেষ করতে দিতে হবে।’ জিয়া তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। মধ্যরাত পর্যন্ত কথা-কাটাকাটি চলল। বিচারপতি সাত্তার সায়েমকে বললেন, ‘ভাই, জিয়া যখন সিএমএলএ-এর পদটা নিতে চাইছেন, পদটা আপনি তাঁকে দিয়ে দিন।’ রাত একটার দিকে সায়েম রণেভঙ্গ দিলেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তরের কাগজে সই করলেন। সাঙ্গ হলো মধ্যরাতের আরেকটি ‘ক্যু’।

২৯ নভেম্বর (১৯৭৬) জারি হলো সামরিক আইনের তৃতীয় ফরমান। রাষ্ট্রপতি সায়েম ঘোষণা করলেন, ‘...যেহেতু আমি এখন উপলব্ধি করছি যে জাতীয় স্বার্থেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিইউ, পিএসসি কর্তৃক প্রয়োগ করা উচিত; সেহেতু এক্ষণে আমি, আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, এই ক্ষেত্রে আমাকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা বলে এবং ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ও ৮ নভেম্বরের ফরমানসমূহের বিধানাবলি সংশোধনপূর্বক এতদ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিইউ, পিএসসি-এর কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তর করছি...।’

কেন জিয়া রাষ্ট্রপতি হলেন

উপ সামরিক আইন প্রশাসক থেকে প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, পরে রাষ্ট্রপতি হলেন জিয়াউর রহমান। এর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছেন রাজনীতিবিদ ও গবেষক মওদুদ আহমদ। তিনি তাঁর গ্রন্থে জিয়াউর রহমানের শাসনকাল অধ্যায়ে লিখেছেন,

‘খন্দকার মোশতাকের মতো ত্বরিত সিদ্ধান্ত না নিয়ে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপে তাঁর যাত্রা শুরু করলেন এবং নিজেকে যথাসম্ভব অবদমিত করে রাখলেন। বিদ্যমান সৈনিক ও জনগণের অভ্যুত্থান, গোলযোগ ও হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে জিয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সরকারের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করা। এই প্রেক্ষাপটে দেশের প্রধান বিচারপতিকে বেসামরিক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করায় সেনাবাহিনীর জেনারেলরা আর সমালোচনার শিকার হলেন না। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে জিয়া এবং সিনিয়র সেনা অফিসাররা একমত হলেন যে ভারতীয় প্ররোচনায় সীমান্ত অঞ্চলে ক্রমাগত হামলাজনিত প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা স্থগিত রাখা উচিত। তবে গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া চালু রাখার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য বামপন্থী নেতা নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়ে জিয়াকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথেষ্ট সাহায্য করে। ২১ নভেম্বর জিয়া সায়েমকে এই বলে একটি ঘোষণাদানে সম্মত করান যে সীমান্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশ ও অব্যাহত সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে একটি ‘নির্বাচন অনুষ্ঠান জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট’ করতে পারে। একই সঙ্গে সায়েম স্থানীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় যে ইউনিয়ন পরিষদের প্রাথমিক পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে। এভাবে জিয়া সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার অভিযোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেন।

একই সঙ্গে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে ক্ষমতা আরও সংহত করার লক্ষ্যে জিয়ার প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। এক সপ্তাহ পরে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জিয়া ক্ষমতার শীর্ষদেশে উঠে আসতে সক্ষম হলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি সায়েম এটা ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন যে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব সেনাবহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর জিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে জিয়া নির্বাহী বিভাগ এবং আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন এবং বিচারপতি সায়েম কেবল একজন ক্ষমতাবিহীন বেসামরিক রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করে রইলেন। জিয়া যখন চূড়ান্ত ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তিনি সায়েমকে ‘ভগ্নস্বাস্থ্যে’র কারণে ইস্তফা দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগের নির্দেশ দিলেন।’

দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ এপ্রিল
সৌজন্যে–সংগ্রামের নোটবুক

২২ এপ্রিল যা ছাপা হয়েছিল

২১ এপ্রিল দেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদের মূল শিরোনাম ছিল-‘প্রেসিডেন্ট পদে জেনারেল জিয়া’। সংবাদটিতে বলা ছিল, ‘বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করায় সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছেন। বাসস জানায়, বিদায়ী রাষ্ট্রপতি গতকাল ১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্টের ঘোষণার বিধান অনুসারে জেনারেল জিয়াকে দেশের নয়া রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন। বিকাল ৫-৩৫ মিনিটে বঙ্গভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন দেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দুই উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম, এইচ, খান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তার, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল এইচ এম এরশাদ, বিডিআর-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী গোলাম দস্তগীর, নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীবৃন্দ।

৪২ বছর বয়স্ক জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের সপ্তম ও সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে জেনারেল জিয়া উপস্থিত সবার সহিত খোলাখুলিভাবে মেলামেশা করেন এবং তাঁদের শুভেচ্ছা কামনা করেন। তাঁর পরনে ছিল কালো রঙের স্যুট।

বিচারপতি সায়েম ১ বছর ৫ মাস ১৫ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে গতকাল পদত্যাগ করেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নয়া রাষ্ট্রপতি মনোনীত করে রাষ্ট্রপতি সায়েম যে আদেশ জারি করেন নিম্নে তার পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হইল:

যেহেতু আমি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্টের ইশতাহারের ক-ধারাবলে মনোনীত হইয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং যেহেতু আমার ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে আমি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে আর সমর্থ নই, সেহেতু উক্ত ইশতেহার অনুযায়ী এবং অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা প্রয়োগ করিয়া আমি এতদ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীরোত্তম, পিএসসিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মনোনীত করিতেছি এবং তাঁহার নিকট রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার অর্পণ করিতেছি, যিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কিংবা তাঁহার মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের অপর কোনো বিচারপতি সমীপে শপথ গ্রহণ করার পর দায়িত্ব গ্রহণ করিবেন।’

সাবেক রাষ্ট্রপতি সায়েম যা লিখেছিলেন

আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের পদত্যাগ যে ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য নয়, তা তিনি পরে খুব স্পষ্টভাবেই লিখেছিলেন। তিনি পদত্যাগ করেছিলেন ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। আর ইংরেজিতে একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন ওই বছরেরই শেষ ও ১৯৭৮ সালের শুরুতে। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর এটি প্রকাশিত হোক। ১৯৯৭ সালের ৮ জুলাই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর দৈনিক ভোরের কাগজে ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেজ’-এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। অনুবাদ করেছিলেন মশিউল আলম। সেটি পরে ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা লিখে গেছেন। এমনকি তাঁর বেসামরিক উপদেষ্টা বা বিশেষ সহযোগীদের ভূমিকার কথাও বলেছেন। বিশেষ করে তিনি নাম নিয়েছেন বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কথা, যিনি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ইতিহাস এতটাই নির্মম যে সেই রাষ্ট্রপতি সাত্তারকেও বন্দুকের নলের মুখে সরে যেতে হয়েছিল। সেবার সামরিক শাসন জারি করেছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ।

আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম হতাশা ব্যক্ত করে লিখেছিলেন যে রাজনীতিকেরা পর্যন্ত পরামর্শের জন্য সেনানিবাসে যেতেন। তারপর তিনি লিখেছেন,

‘আশ্চর্যজনক যে বিশেষ সহযোগী, যিনি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, তিনিও সেই দলে ছিলেন। এটা সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক বিশেষভাবে এই কারণে যে বিশেষ সহযোগী ব্যক্তিগতভাবে জানতেন যে তাঁকে মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়া সক্রিয় করার জন্য এবং তিনি জানতেন যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে, আমাকে এবং তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণসহ কাউন্সিলের সব সদস্যকে মন্ত্রিসভা ত্যাগ করতে হবে। তা করতে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি সহজেই আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু উল্টো তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রইলেন। একজন ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সব বেসামরিক সদস্যও তা-ই করেছেন। তাঁদের সবাইকে মনোনীত করেছিলাম এবং নিয়োগ দিয়েছিলাম আমি। কাউকে কটাক্ষ করার জন্য বলছি না। এ দেশের বর্তমান রাজনীতিকদের মানসিক গড়ন সম্পর্কে আমার ধারণা এ থেকে ফুটে ওঠে।’

সাবেক রাষ্ট্রপতি সায়েম আরও লিখেছেন, ‘সে সময় আমি আরও যা লক্ষ করেছি তা হলো রাজনীতিকেরা নির্বাচনের প্রতি বিরূপও ছিলেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রধান মনে করতেন যদি তাঁর দল নির্বাচিত না হয় তা হলে নির্বাচনে যাওয়া অর্থহীন। মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলো সেনানিবাসে গিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা করতেন। দুর্ভাগ্যজনক যে কিছু ন্যূনতম বিষয়ে রাজনীতিকেরা নিজেদের মধ্যে কোনো বোঝাপড়ায় আসতে পারেননি; শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যেও তাঁরা নিজেদের মধ্যে কোনো সমঝোতা করতে পারেননি। পরিস্থিতি ছিল এ রকম। এবং আমি সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ দ্রুত হারাচ্ছিলাম। তখন আমি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা চিন্তা করি। ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গজনেরা বললেন, নির্বাচন না করে আমি যদি বেরিয়ে আসি, সেটা হবে আমার জন্য একটা ব্যর্থতা। আমি তাঁদের বলেছিলাম, সেটা শুধু আমার একার ব্যর্থতা হবে না, সমগ্র জাতির ব্যর্থতা হবে। বিশেষ করে তাঁদের ব্যর্থতা, যাঁরা নিজেদের রাজনীতিক বলেন অথচ সেনানিবাসের সাহায্য ছাড়া নির্বাচনে যেতে চান না।’

১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিশেষ সহযোগীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা কাউন্সিলের কতিপয় সিনিয়র বেসামরিক সদস্য আমাকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার অনুরোধ করেন। তাঁরা বলেন, তাঁরা তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে কাজ করতে চান।
আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, সাবেক প্রেসিডেন্ট

নিয়োগ ও পদত্যাগের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম এর পর লিখেছেন, ‘আগেই বলা হয়েছে, সংবিধান কার্যকর ছিল, যদিও খন্দকার মোশতাক আহমদ ঘোষিত সামরিক আইনের অধীনে সংবিধানে কিছু বিধি যোগ, বিয়োগ, পরিবর্তন, সংশোধন করার সুযোগ ছিল। ভবিষ্যতে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সমর্থিত হবে এমন একটা ভ্যালিডেশন অব র‍্যাটিফিকেশন অ্যাক্ট-এর সম্ভাবনার বলেই শুধু সংশোধনীগুলো আনা যেত। জনগণ কর্তৃক সংশোধনীগুলো সমর্থিত হবে এমন ক্ষেত্রেই শুধু র‍্যাটিফিকেশন অ্যাক্ট প্রত্যাশা করা যেত। ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর প্রকাশিত আমার ঘোষণা আদেশের অধীনে সরকারের অন্যান্য পদের সঙ্গে ভাইস রাষ্ট্রপতির পদটিও বাতিল হয়। আবার, ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর আমার ঘোষিত আদেশের অধীনে আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব ছেড়ে দিই সে সময়কার উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে। এভাবে সংবিধান বা ঘোষণা আদেশ কোনোটারই কোনো পরিবর্তন-সংশোধনের অধিকার আর আমার হাতে থাকে না। একরকম দুর্দশায় পড়ে আমি ভাবছিলাম, কোনোরূপ সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না করে আমি কীভাবে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরে আসতে পারি। কারণ আমি আমার পদত্যাগপত্র যাকে সম্বোধন করে লিখব, সে রকম কেউ ছিল না।’

সাবেক রাষ্ট্রপতি এও লিখেছেন, ‘১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিশেষ সহযোগীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা কাউন্সিলের কতিপয় সিনিয়র বেসামরিক সদস্য আমাকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার অনুরোধ করেন। তাঁরা বলেন, তাঁরা তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে কাজ করতে চান। এতে কি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় না যে এমনকি ক্ষমতাসীন থেকেও বেসামরিক ব্যক্তিগণ সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করতে চান? আমি তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করতে সম্মত হই। বিশেষ সহযোগীর মারফতে আমি নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের ডেকে পাঠাই। তাঁদের ডেকে পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ সহযোগীকে খুবই আগ্রহী মনে হয় আমার। তাঁরা এলে আমি আমার পদত্যাগের ব্যাপারে তাঁদের মতামত জানতে চাই, কারণ আমার দৃষ্টিতে মনে হয় যে আমার পদত্যাগের ফলে সশস্ত্র বাহিনীসমূহের ভেতরে মতভেদ দেখা দিতে পারে, যা দেশের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। তাঁদের মতামত ও সম্মতি পাওয়ার পর আমি বিশেষ সহযোগীর মাধ্যমে জিয়াকে আসতে বলি।

জিয়া যদি চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবেই থাকতেন, তাহলে সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে লাভবান হতো। সেনাবাহিনীর মধ্যে তিনি একজন স্বভাবজাত নেতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাঁর অবদান অবশ্যই অমূল্য।
আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম

জিয়া আসার পর আমি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করি যে যেহেতু আমার পদত্যাগপত্র কাকে সম্বোধন করে লেখা হবে বা কার কাছে দাখিল করা হবে, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে, কারণ সে রকম কেউ নেই, সুতরাং কীভাবে আমি পদত্যাগ করব। তা ছাড়া খন্দকার মোশতাক আহমদ আমাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়ার সময় যেভাবে সামরিক আইন ঘোষণা আদেশে সংশোধনী এনেছিলেন, সে রকমটা আমি করতে পারি না। একজন ভাইস রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতি এবং ঘোষণা আদেশ এবং/বা সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতার অভাব আমার পদত্যাগের পথে বাধা হিসেবে ছিল। বিশেষ সহযোগী সমস্যাটি উপলব্ধি করলেন। তিনি উঠে আইনসচিবের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য তাঁর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে অবশ্য তাঁর আসনে বসে থাকতেই বলা হলো। জিয়া বললেন, তিনি ইতিমধ্যেই যখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে গেছেন, তখন এ রকম সংকট তিনি মোকাবিলা করবেন সামরিক আইনের কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে। এভাবে আশ্বস্ত হয়ে জিয়ার অনুকূলে আমি একটি পদত্যাগপত্র লেখার নির্দেশ দিই; তাতে পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করি আমার অসুস্থতা ও জাতীয় স্বার্থের কথা।

যেহেতু জিয়া রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছেন এবং আমার মনে হয়েছে যে, উপদেষ্টা কাউন্সিলের অধিকাংশ সদস্যই তাঁকে সমর্থন করেছেন, তাই আমি তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করি যে তিনি নিজে কোনো হুমকির সম্মুখীন না হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বাবলি সামলাতে পারবেন কি না। তিনি হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। অবশ্য অল্প কয়েক মিনিট পরে তিনি বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীগুলোতে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পরে, তবে তিনি সেসব কাটিয়ে উঠতে পারবেন। যেহেতু তখন আমার সব মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল আমার চিকিৎসা আর কীভাবে পদত্যাগ করা যায় এ নিয়ে, তাই আমি আর কিছু জিয়াকে বলিনি। তবে আমার মনে হয়েছিল যে তাঁকে ভুল পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু আমি ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে আমি পদত্যাগ করব, কারণ আমি দ্রুতই সরকারের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলাম, তা ছাড়া স্বাস্থ্যগত কারণও ছিল।’

আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম

আমার মতে, ‘জিয়া যদি চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবেই থাকতেন, তাহলে সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে লাভবান হতো। সেনাবাহিনীর মধ্যে তিনি একজন স্বভাবজাত নেতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাঁর অবদান অবশ্যই অমূল্য। সেনাবাহিনীতে জওয়ানরা মনে করে তাঁর মাথার চারপাশে একটা জ্যোতির্বলয় আছে। আমার মনে হয়েছে, চিফ অব আর্মি স্টাফ-এর পদ থেকে সরে গিয়ে তিনি একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন।’

রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে আমি জিয়াকে বলি, ‘আমি যেহেতু নির্বাচন করে যেতে পারলাম না, আমি তাঁকে অনুরোধ করব যেন তিনি নির্বাচন দেন। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন যে তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। শুনে আমি খুশি হই। কিন্তু আমি তখন ভাবতে পারিনি যে নির্বাচনে তিনি নিজেই অংশ নেবেন। সে রকম ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণ করবেন এমন চিন্তা তখন আমার মাথায় আসেনি।

বস্তুত জিয়া তাঁর অবস্থান সংহত করার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে একটা গণভোট করে ফেলেন। তাঁর প্রতি এবং তাঁর ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি ভোটারদের আস্থা আছে কি না, এই ছিল গণভোটের বিষয়। কিন্তু সেই গণভোটে হ্যাঁ বাক্সে এত বেশি ভোট পড়ে যে জনগণ সেই ফলাফলকে হাস্যকরভাবে অবিশ্বাস্য মনে করে।’

সবশেষে সাবেক রাষ্ট্রপতি সায়েম লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ফলে আমার ঘাড় থেকে একটা ভারী বোঝা নেমে যায়। কিন্তু নির্বাচন হতে পারেনি, আর তাই আমার মিশনও পূর্ণ হয়নি। তা ছাড়া আমি নিজেই বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবছিলাম। অল্প কয়েক দিন পর কমনওয়েলথ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সে সম্মেলনে আমার যাওয়ার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। কমনওয়েলথ সম্মেলনের কারণে আমার পদত্যাগে কিছুটা তাড়াহুড়া করা হয় বলে আমার মনে হয়। কিন্তু সেই সম্মেলনে জিয়া আমার পক্ষ থেকে এবং আমার আশীর্বাদ নিয়ে বেশ ভালোভাবেই অংশ নিতে পারতেন, যেমনটা তিনি এ রকম অনেক অনুষ্ঠানে করেছেন।

যেভাবে হঠাৎ এবং তড়িঘড়ি করে আমাকে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, সে জন্য এবং জিয়ার পক্ষে ওকালতির জন্যও আমার মানসিক চাপ বোধ হয়েছে, ক্ষোভ হয়েছে। পরিস্থিতির এই জটিলতা বেশ ভালোভাবেই এড়ানো সম্ভব ছিল; বা অন্তত হ্রাস করা যেত, উপদেষ্টা কাউন্সিলের ভেতরে ও বাইরে জিয়ার অনুসারীরা যাঁরা ইতিমধ্যে জিয়ার বশীভূত হয়ে গেছেন, যদি একটু বিবেচক এবং কৌশলী হতেন। হয়তো জিয়ার ভক্তরা চেয়েছিলেন (কমনওয়েলথ সম্মেলনে) জিয়া যেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সমান অবস্থান থেকে করমর্দন করতে পারেন।’