‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’

সুখী দেশের তালিকার প্রথমে যেমন ফিনল্যান্ড, তেমনি অবসাদগ্রস্ত মানুষেরা যে ওষুধ ব্যবহার করেন, সেই ওষুধ সেবনেও সবার ওপরে ফিনল্যান্ড।

প্রতীকী ছবি

‘নিজের ভায়রার চেয়ে যাঁর আয় ১০০ টাকা বেশি, তিনিই সুখী’—এক ব্যক্তির সরস মন্তব্য। এর মধ্যে রসিকতা আছে বটে, তবে সেটুকু বাদ দিলে যা থাকে—মানুষ সুখী কি না, তা বোঝার একটা উপায় ‘তুলনা’। তর্ক চলতে পারে এই উপায় নির্ধারণের পন্থা নিয়ে, কিন্তু একটা তুলনামূলক চিত্রই আমরা ফি বছর পাই ‘বিশ্ব সুখ সূচকে’।

সবশেষ ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী, ফিনল্যান্ড সবচেয়ে সুখী দেশ। পরপর ছয় বছর শীর্ষ অবস্থানে দেশটি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ছিল ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড। চতুর্থ ইসরায়েল ও পঞ্চম নেদারল্যান্ডস। অন্যদিকে সুখী দেশের তালিকায় তলানিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান।

১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৮তম অবস্থানে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। প্রতিদিন টেলিভিশন, অনলাইন বা মুঠোফোনের পর্দায় সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে সেই যুদ্ধের খবরাখবর। অথচ ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় দেশই গত বছর সুখ সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল। পাকিস্তান, এমনকি মিয়ানমারেরও পেছনে ছিল বাংলাদেশ। এর আগের বছর, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৪তম।

প্রতিবছর ২০ মার্চ বিশ্ব সুখ দিবসে ‘সুখী দেশের তালিকা’ প্রকাশ করে জাতিসংঘ। কীভাবে করা হয় এই তালিকা?

এ ক্ষেত্রে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়ন, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আমলে নেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রতিটি দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও দুর্নীতির মাত্রা বিবেচনায় নেওয়া হয়। ‘সুখ’-এর মাপকাঠি হিসেবে এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়, যা চরিত্রগতভাবে বস্তুতান্ত্রিক, আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। কম জনসংখ্যার নর্ডিক দেশগুলোর তালিকায় আধিক্য সেটিই ইঙ্গিত করে। যেসব দেশের জিডিপি বেশি, সুখী দেশের তালিকাতেও সেসব দেশই থাকে ওপরের দিকে।

প্রশ্ন হলো সুখ কী? একে কি কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায়, কোথায় এর ঠিকানা, নাকি সুখ শুধুই ‘সোনার হরিণ’? ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়ার সুখ আর সংগীতপ্রেমী কারও গান শোনার সুখ কি এক হতে পারে? পারে না। এসব প্রশ্ন আদিকাল থেকেই মানুষের মনে উঁকি দিচ্ছে। ফলে সুখের তত্ত্বতালাশে গবেষকেরা কম ঘাম ঝরাননি। সাহিত্য, সংগীত বা শিল্পকলায় সুখ নিয়ে আছে অঢেল উচ্চারণ, উপস্থাপন। এ নিয়ে বহু কথা বলেছেন দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা। তবে তাঁদের মধ্যে মতভিন্নতাও কম নয়।

তবে সুখের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক অস্বীকার করার জো নেই। যতই বলা হোক ‘অর্থই অনর্থের মূল’, সুখ সূচকে তার প্রতিফলন কিন্তু স্পষ্ট। সুখের এই ‘গাণিতিক পরিমাপ’ নিয়ে সাড়া-জাগানো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, শিরোনাম ‘হাই ইনকাম ইমপ্রুভস ইভল্যুশন অব লাইফ বাট নট ইমোশনাল ওয়েল–বিয়িং’। সেখানে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদ ডানিয়েল কানেম্যান ও অ্যাঙ্গাস ডিটন (পরে ২০১৫ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান) যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে দেখান যে আয়ের সঙ্গে ‘সুখ’ বাড়ে বটে, কিন্তু আয় যখন মোটামুটি বছরে ৭৫ হাজার ডলারের ঘরে থাকে। পরে আয় বাড়লেও সুখের পারদ আর চড়ে না। অঙ্কটা আজকের বাজারে মোটামুটি লাখ ডলার। বলাই বাহুল্য, দেশটির ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এতটা আয়রোজগার করেন না।

কানেম্যান-ডিটনের ওই গবেষণার প্রভাব কতটা পড়েছিল তার একটা উদাহরণ হতে পারেন মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্র্যাভিটি পেমেন্টসের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড্যান প্রাইস। তিনি ১২০ কর্মচারীর সবার বেতন বাড়িয়ে বছরে ৭০ হাজার ডলার করে দেন। এই অতিরিক্ত টাকা জোগাতে নিজের বেতন ১১ লাখ ডলার থেকে ছেঁটে করেন ৭০ হাজার ডলার। তাঁর লেখা বই ওয়ার্থ ইট–এ রয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা। মজার ব্যাপার, ২০২১ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ম্যাট কিলিংসওয়ার্থ আরেক গবেষণায় দেখালেন, অর্থকড়ির সঙ্গে ভালো থাকা বাড়তেই থাকে; এর কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। নানা সমীক্ষার তথ্যও বলছে, গড়পড়তা যাঁদের আয় বেশি, তাঁরা বেশি সুখী।

এই যদি হয় অর্থের সঙ্গে সুখের ‘সম্পর্ক’, তবে বোঝাই যাচ্ছে অর্থকে বাদ দিয়ে ‘সুখ’ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা তো সেই গল্পটাও জানি—এক ধনী ব্যক্তির অসুখ সারানোর জন্য নিদান দেওয়া হয়েছিল সুখী মানুষের জামা পরার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন সুখী মানুষকে পাওয়া গেল বটে, কিন্তু দেখা গেল, তার জামা নেই। তিনি সম্পদশূন্য এবং সে কারণেই সুখী।

‘সুখ’ পরিমাপের ধারণাটা এসেছে হিমালয়–কোলের ছোট্ট দেশ ভুটান থেকে। ১৯৭৯ সালে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) বিমানবন্দরে এক সাংবাদিককে ভুটানের রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক বলে বসলেন, মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিএনপি) চেয়ে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ) বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরে ২০০৮ সাল নাগাদ বিষয়টি আবার সামনে আনে ভুটান। বাকি দুনিয়াও তা লুফে নেয়। যদিও সুখ পরিমাপের মানদণ্ড অনেকটা বদলেও যায়। এরপর ২০১২ সাল থেকে প্রকাশ করা হচ্ছে ‘বিশ্ব সুখ সূচক’।

অবশ্য প্রশ্ন আছে, যে পন্থায় ফিনল্যান্ডের সুখ মাপা হচ্ছে, নাইজার কিংবা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে তা কি সম্ভব? সুখী দেশের তালিকার প্রথমে যেমন ফিনল্যান্ড, তেমনি অবসাদগ্রস্ত মানুষেরা যে ওষুধ ব্যবহার করেন, সেই ওষুধ সেবনে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে দেশটি! তাই কিছু প্রশ্নের মীমাংসা এখনই হয়তো হবে না। কিন্তু এ কথাও তো স্বীকার করতেই হয়, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যও ‘সুখে থাকা’। ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ বিশ্বের সব মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিতের লক্ষ্যে দিবসটি পালন করা হবে, এ কথাই বলা আছে জাতিসংঘের প্রস্তাবে। বলা আছে এ কথাও—সুখের অনুসন্ধান একটি মৌলিক মানবিক লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যকেও তো কোনোভাবে খাটো করা যায় না।

মনোবিদদের ভাষ্যে, আপনি কীভাবে জীবনযাপন করেন, সুখ নির্ভর করে তার ওপর। অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান, ভালোবাসা, সম্পর্ক— আপনার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এসব বিষয়ে একেকজনের একেক মত থাকবে। আর যা আপনাকে সুখী করবে, তা অন্যকে না–ও করতে পারে। ব্যক্তিভেদে সুখের উৎস তাই ভিন্ন। ২০২২ সালে দ্য গুড লাইফ বইয়ে রবার্ট ওয়ালডিংগার ও মার্ক শুলজ অবশ্য সুসম্পর্ককেই ‘সুখী জীবনের’ মন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু দুর্নীতির বিস্তার, বিভাজনের রাজনীতি, আয়বৈষম্যের বাড়বাড়ন্ত, ক্ষুধা, বেকারত্ব নিয়ে, ভয় নিয়ে সুখে থাকা কি যায়? মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই শেষ কথা নয়। আর্থিক প্রবৃদ্ধির বাইরেও কথা থাকে। সুখের অন্বেষণে জীবনের আদর্শের মানদণ্ডও তো দিন দিন বদলে যাচ্ছে। অসহিষ্ণুতা, দূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদিও জীবনকে জর্জর করে তোলে।

এ বছর বিশ্ব সুখ দিবসের প্রতিপাদ্য—‘যূথবদ্ধ থাকাতেই সুখ’, অর্থাৎ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে সুখী হওয়া যায়। ‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।’ এই আশার ভেলা ডুবতে দেওয়া যাবে না। আর এ জন্যই চাই যূথবদ্ধ থাকা; ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’