সহজ প্রযুক্তির ব্যবহারে বাঁচল সাপে কাটা রোগী
নীলফামারীর কয়েকজন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নীরবে দারুণ একটা কাজ করে ফেলেছেন। একজন দরিদ্র সাপে কাটা রোগীকে নির্ঘাত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে। উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করার আগে রোগীর দমটা ধরে রাখতে ব্যবহার করেছেন আর্টিফিশিয়াল ম্যানুয়াল ব্রিদিং ইউনিট, যা অ্যাম্বু ব্যাগ নামে পরিচিত। এটি কৃত্রিম উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাস সহায়ক যন্ত্র। ব্যাগ-ভাল্ভ-মাস্ক নামেও এটি পরিচিত।
খুব মামুলি এই চিকিৎসাযন্ত্রের বেলুনের মতো ফোলা অংশটি হাতে চাপ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্টে থাকা রোগীকে শ্বাস চালিয়ে যেতে সাহায্য করা যায়। রোগী যখন দম নিতে পারেন না, তখন এটা ব্যবহার করা হয়।
খবরটা শুনে মনে পড়ে গেল ‘সায়েবাস মেথড’–এর কথা। শ্রদ্ধেয় ডা. সায়েবা আক্তারের উদ্ভাবিত সায়েবাস মেথড প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত বন্ধ করার জন্য একটি কার্যকর কৌশল। দরিদ্র অসহায় প্রসূতিদের মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে অসাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন সায়েবা আক্তার। অনেক দেশে এখন এই সস্তা ও সহজ, তবে খুব কার্যকর পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
সায়েবাস মেথড নিয়ে ‘লাখো মায়ের জীবন রক্ষায় বাংলাদেশের প্রযুক্তি’ শিরোনামে ২০১৭ সালে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদনে ছাপা হয়েছিল। তখন সায়েবা আক্তার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পদ্ধতিটি অতি সরল। একটি ক্যাথেটারের মাথায় কনডম বাঁধা হয়। সেই কনডম জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। ক্যাথেটারের অন্য প্রান্তে স্যালাইন লাগানো হয়। পানি ঢোকার কারণে কনডম বড় হতে থাকে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে জরায়ুর ভেতরের দেয়ালে চাপ সৃষ্টি করে। এভাবে ২৪ ঘণ্টা রাখা হয়। এরই মধ্যে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। পুরো কিট তৈরি করতে ১০০ টাকার কম খরচ পড়ে। দরকার শুধু প্রশিক্ষণ।
গত ২৯ জুলাই সকালে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার একজন কৃষক (সামাজিক সুরক্ষার কারণে নাম প্রকাশ করা হলো না) পাটখেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। আগের দিনের কেটে রাখা পাট জাগ দিতে পানিতে চুবিয়ে রাখতে হবে। দল বেঁধেই গিয়েছিলেন, যেমন যান সব সময়। পাটের আঁটির মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল কালাচ পরিবারের বিষধর সাপ ‘ওয়ালস ক্রেইট’। ওই কৃষকের পায়ে কামড় বসিয়ে দেয় সাপটি। ওয়ালস ক্রেইটকে অনেকে কালাচ বলে ভুল করেন। এটা কালাচ পরিবারভুক্ত হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির সাপ। কালাচ কামড়ালে চট করে টের পাওয়া যায় না। এর বিষক্রিয়া শুরু হতেও অনেক সময় লাগে। তাই বিশেষজ্ঞরা কালাচকে নীরব ঘাতক বললেও ওয়ালস ক্রেইটকে নীরব বলতে রাজি নন।
ওই কৃষকও সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়েছিলেন। সঙ্গের লোকজন সাপটিকে মেরে তাঁর পায়ে তিনটি গিঁট দিয়ে জলদি ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান; কিন্তু বিধি বাম। সাপের বিষ নষ্ট করার ওষুধ অ্যান্টিভেনম নেই উপজেলায়। এটা এখন প্রায় সব সরকারি হাসপাতালের নিত্যঘটনা। সাধারণ ওষুধেরই সরবরাহ নেই, তার ওপর অ্যান্টিভেনম!
পাটের আঁটির মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল কালাচ পরিবারের বিষধর সাপ ‘ওয়ালস ক্রেইট’। ওই কৃষকের পায়ে কামড় বসিয়ে দেয় সাপটি। ওয়ালস ক্রেইটকে অনেকে কালাচ বলে ভুল করেন। এটা কালাচ পরিবারভুক্ত হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির সাপ।
ডোমার থেকে নীলফামারী সদর দূরের পথ, তা ছাড়া সেখানে গিয়ে যে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যাবে, তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? এসব সাতপাঁচ ভেবে ওই কৃষককে তাঁর সাথিরা নিয়ে যান কাছের এক ওঝার কাছে। ওঝা পায়ের বাঁধন খুলে দেন, চুন দিয়ে একটি দাগ দেন এবং বলেন, আর কোনো সমস্যা নেই। বিষ আর ওপরে উঠতে পারবে না; কিন্তু বিষয়টা যে ওয়ালস ক্রেইটের। কিছুক্ষণ পর রোগীর সমস্যা শুরু হয়, মুখ দিয়ে লালা আসে, শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। ওঝা বুঝে ফেলেন বুজরুকি চলবে না; জানান রোগীকে ‘সুই’ দিতে হবে। রংপুর সদর হাসপাতাল ছাড়া উপায় নেই।
পাটখেতের দিনমজুরদের পক্ষে ডোমার থেকে রংপুর যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ঠিক হয়, একবার ‘শেষ চেষ্টা’ করবেন। নীলফামারীর হাসপাতালে হয়তো ওষুধ মিলতেও পারে, রংপুরে যাওয়ার ঝক্কি থেকে বাঁচতে এই আপস। তা ছাড়া সময়টা সাপে কাটা রোগীর জন্য একটি বড় ব্যাপার। গোল্ডেন ১০০ মিনিট আর নেই। তবু রোগীর লোকজন রোগীকে বেলা একটা নাগাদ নীলফামারী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।
সেখানে মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল মতিন রোগীকে পরীক্ষা করে বিষক্রিয়ার আলামত পান। ডা. মতিন বলেন, বেলা একটার দিকে রোগীকে আনা হয়। ততক্ষণে রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট ছিল। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। তখন তিনি দ্রুত রোগীর শ্বাসনালিতে টিউব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর এক ডোজ অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে ডা. মতিন অবস্থার জটিলতা অনুধাবন করে ‘স্নেক ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে’ বার্তা দিয়ে রাখেন। যাতে রংপুরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তৈরি থাকেন এবং আইসিইউ নিয়ে কোনো ভেজাল না বাধে। ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হবে; ডা. মতিনের জরুরি বার্তাটি অধ্যাপক এম এ ফয়েজের নজরে আসে।
নীলফামারী সদর হাসপাতালটি জেলার নতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য ব্যবহৃত হয়। হলে কী হবে, সেখানে কোনো আইসিইউ নেই। আইসিইউ ছাড়া শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রেখে বাকি ৯ ডোজ দিয়ে রোগীকে আশঙ্কামুক্ত করা অসম্ভব। কাছে আইসিইউ আছে কেবল রংপুরে। সিদ্ধান্ত হয় রোগীকে রংপুরে পাঠানো হবে; কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখতে হবে। খুব দ্রুত গেলেও দেড় ঘণ্টার ধাক্কা। ব্যাগ-ভাল্ভ-মাস্ক বা অ্যাম্বু একমাত্র ভরসা। সারা রাস্তা পালা করে স্বাস্থ্যকর্মীরা অ্যাম্বু পাম্প করে রোগীকে শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে রংপুরে নিয়ে যান।
এরই মধ্যে ডা. মতিন অবস্থার জটিলতা অনুধাবন করে ‘স্নেক ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে’ বার্তা দিয়ে রাখেন। যাতে রংপুরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তৈরি থাকেন এবং আইসিইউ নিয়ে কোনো ভেজাল না বাধে। ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হবে; ডা. মতিনের জরুরি বার্তাটি অধ্যাপক এম এ ফয়েজের নজরে আসে। অধ্যাপক এম এ ফয়েজ এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি রংপুরের সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। দ্রুত আইসিইউর ব্যবস্থা হয়।
রোগীকে অতি দ্রুত ভেন্টিলেটর মেশিনে দেওয়া হয়। রাতে একবার খবর আসে রোগীর অবস্থা ভালো না। বলা হয় আর কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে ‘ডেথ ডিক্লেয়ার’ করা হবে; কিন্তু হাল ছাড়েনি স্নেক ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ; রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ ও আইসিইউর চিকিৎসক, নার্স। সবার প্রচেষ্টায় রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিন ঘণ্টা আম্বু ব্যাগ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার ঘটনাটি কেবল বিরল নয়; বরং সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় এক সৃজনশীলতার প্রতীক হয়ে থাকবে।
দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে সাপের কামড়ের অ্যান্টিভেনম ব্যবহার (মজুত থাকা সত্ত্বেও) না করার কারণ হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর ব্যবস্থা না থাকা। ঝামেলা এড়াতে সাপে কাটা রোগীদের পত্রপাঠ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে বেশির ভাগ সময় রোগী মারা যায়। এ সমস্যা সমাধানে অ্যাম্বু ব্যাগ বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে এই অ্যাম্বু ব্যাগের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব। দামও ১০০ টাকার মধ্যে এবং একটি ব্যাগ দীর্ঘদিন ব্যবহার করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরত চিকিৎসকদের আন্তরিকতা। সেই সঙ্গে দরকার চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি অনুকূল কর্মপরিবেশ তৈরিতে মন দেওয়া। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মানুষকে গরম করলে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে; কিন্তু সেটি টিকবে না। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করার কাজে মনোযোগী হতে হবে, তাহলেই চিকিৎসকেরা তাঁদের সৃজনশীলতা দেখাতে পারবেন। লাগসই আর সহজ পথগুলোর দিশা দিতে পারবেন।
[এই লেখায় কিছু তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ডা. রাতিন্দ্র মণ্ডল, তাঁকে অনেক ধন্যবাদ]
# গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক, গবেষক: [email protected]