যেন এক টুকরা বাংলাদেশ

নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় বিক্রি হচ্ছে বাহারি ইফতারিছবি: প্রথম আলো

বিকেলে সূর্যের তাপ কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ৭৩ নম্বর সড়কের জনসমাগম। ভেসে আসে সুর—‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়,/ আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।’ এই সুরের উৎস সন্ধানে রেস্তোরাঁয় যেতেই দেখা যায় ছোলাবুট, পেঁয়াজু, বেগুনি, খিচুড়ি, জিলাপিসহ অন্তত ৪০ প্রকার ইফতারির সমারোহ। টেবিলে ইফতারির প্লেট আর শরবত নিয়ে অপেক্ষায় আছেন রোজাদারেরা। ইফতারি কিনে বাসায় নেওয়ার জন্য লাইনে অপেক্ষায় আছেন অনেকে।

এ বর্ণনা শুনে অনেকে মনে করতে পারেন, এটি বাংলাদেশে রোজার মাসে কোনো ইফতারির বাজারের কথা বলা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা বলছি, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা জ্যাকসন হাইটসের কথা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ৩৭ অ্যাভিনিউয়ের ৭৩ নম্বর সড়ক। বাংলাদেশিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এর বর্তমান নাম বাংলাদেশ স্ট্রিট। রুজভেল্ট অ্যাভিনিউর ৭৪ স্ট্রিট থেকে ৮২ স্ট্রিট পর্যন্ত এলাকা জ্যাকসন হাইটস নামে পরিচিত।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিরা জ্যাকসন হাইটস বলতে বোঝেন ৭৩ নম্বর সড়কের এই একটি ব্লককে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ অঞ্চলের ৭৭ হাজার বাসিন্দার মধ্যে ৫০ শতাংশ স্প্যানিশ, ১৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ, ১ শতাংশ আফ্রিকান–আমেরিকান আর ৩২ শতাংশ এশিয়া মহাদেশের; এর মধ্যে মাত্র ৫ ভাগ মুসলিম। সেই হিসাবে ৩ হাজার ৮০০ জন মুসলিম এই অঞ্চলে বসবাস করেন। তাঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের নাগরিক।

কিন্তু বাংলাদেশ স্ট্রিটে প্রবেশ করলে অনেকেই বুঝতে পারেন না, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন নাকি বাংলাদেশে।

জ্যাকসন হাইটসে প্রতিদিনই বাহারি ইফতারির পসরা নিয়ে বসছে বাংলাদেশি মালিকানাধীন নয়টি রেস্তোরাঁ। নিউইয়র্কে অন্যান্য বাঙালি–অধ্যুষিত জ্যামাইকা, ব্রুকলিন, ম্যানহাটান ও দ্য ব্রংকসও তার ব্যতিক্রম নয়। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও নিউইয়র্ক শহরের অন্যান্য স্থান থেকে এখানে আসেন বাংলাদেশিরা, বৈচিত্র্যময় ইফতারির স্বাদ নিতে।

কেননা, এখানে প্রতিদিন ইফতারের জন্য আলাদা করে বানানো হয় ৪০ থেকে ৫০ পদের খাবার। জ্যাকসন হাইটসের বেশির ভাগ রেস্তোরাঁর সামনে ফুটপাতেও বিক্রি হতো ইফতারি। ১০ থেকে ১২ পদের ইফতারির একটি বক্সের মূল্য ছিল ১০ থেকে ১৪ ডলার। হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়া ও টানা বৃষ্টির কারণে ফুটপাতের বিক্রি এখন বন্ধ আছে।

জ্যাকসন হাইটসের প্রতিটি রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় ইফতারির কিছু বিশেষ পদ। যেমন প্রিমিয়াম রেস্টুরেন্টের একেকটি শাহি জিলাপির ওজন হয় এক থেকে দেড় পাউন্ড। বিক্রি হয় ২২ ডলারে। অন্যান্য রেস্তোরাঁয় সাধারণ জিলাপি ৭ ডলার করে। হাটবাজার রেস্টুরেন্টের হালিম ১০ ডলার এবং বড় মাছের গ্রিল ২৫ ডলার। নবান্ন রেস্টুরেন্টের লাচ্ছা পরোটার দাম সাড়ে ৩ ডলার আর বিহারি কাবাব ১২ ডলার। শুধু নবান্ন এবং মামাস রেস্টুরেন্টে রয়েছে পার্টি হল। যেখানে প্রতিদিনই নানান সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও জেলাভিত্তিক সংগঠনগুলো ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

দ্য ব্রংকস থেকে প্রায়ই আধা ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ইফতারের জন্য জ্যাকসন হাইটসে আসেন কবির হোসেন। তাঁর বাসায় খুব সুস্বাদু ইফতারি তৈরি হয়। তারপরও সুযোগ পেলেই বহু ধরনের এবং বৈচিত্র্যময় স্বাদের ইফতারির জন্য চলে আসেন জ্যাকসন হাইটসে। কবির হোসেন বলেন, ‘প্রায় দিনই রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার জায়গা পাই না, তাই প্রতিটি আলাদা রেস্তোরাঁ থেকে নামকরা খাবারগুলো নিয়ে যাই। দুই সন্তান আর বউ খুব পছন্দ করে।’

পরিবার নিয়ে মানসম্মত পরিবেশে ইফতার করার অন্যতম জায়গা মান্নান গ্রুপের শেফস মহল রেস্টুরেন্ট। সেখানকার কড়াই গোশত বিক্রি হয় ৫০ ডলারে, যা অন্তত পাঁচজনে খাওয়া যায়। ডাইভারসিটি প্লাজার সামনে অবস্থিত ইত্যাদি গ্রিল অ্যান্ড গার্ডেনের রুমালি রুটি ও চিকেন প্যাটিস যথাক্রমে বিক্রি হয় সাড়ে ৩ ও ২ ডলারে। ৩৭ অ্যাভিনিউর আবদুল্লাহ সুইটসের গরম-গরম মিষ্টি ৭ ডলারে বিক্রি হয় এক বক্স।

তার বিপরীত দিকে কথা রেস্টুরেন্টের গ্রিলড আস্ত মোরগের দাম ২৫ ডলার এবং পাকোড়া আর আলাপিনু ভাজা প্রতিটি ১ ডলার। পাশে ঢাকা গার্ডেনে কাচ্চি বিরিয়ানি ও বোরহানি ২৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।

মোহাম্মদ ইয়াসিন জ্যাকসন হাইটস এলাকার বড় চারটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জানান, ছোট–বড় মিলিয়ে এখানে কয়েকটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। বড় চারটি রেস্তোরাঁয় শুধু ইফতারি বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার ডলারের। ছোট ও মাঝারি রেস্তোরাঁয় বিক্রির পরিমাণ ৫ থেকে ১০ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে জ্যাকসন হাইটসে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ ডলারের ইফতারি বিক্রি হয়।