সাক্ষাৎকার

ভূমিকম্প–সহনীয় ভবন নিশ্চিত করতে হবে

সম্প্রতি দেশজুড়ে ঘন ঘন ভূকম্পন অনুভূত হওয়ায় জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। ভূমিকম্প–সহনীয় স্থাপনা নির্মাণে করণীয় ও  বিল্ডিং কোড অনুসরণের গুরুত্ব কতটা—এসব বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামসুল হক মো. মিরাজ। 

প্রথম আলো:

একটি স্থাপনা নির্মাণের শুরুতেই মাটির গুণাগুণ যাচাই ও ভিত্তি মজবুত নিশ্চিত করা কতটা জরুরি?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: ভবন নির্মাণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে মাটি, নির্মাণ উপকরণ ও মজবুত ভিত্তির কৌশলের ক্ষেত্রে। ভূমিকম্প–সহনীয় স্থাপনার জন্য এটিই প্রথম এবং প্রধান শর্ত। উচ্চ মাত্রার কম্পনে স্থাপনাকে অক্ষত রাখতে হলে ভবনের ফাউন্ডেশনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা না করে ভবন নির্মাণ করা মানে একটি দুর্বল কাঠামোর ওপর পুরো বিল্ডিং দাঁড় করানো। যেখানে মাটি নরম বা দুর্বল, সেখানে অবশ্যই বিশেষ ধরনের মজবুত ফাউন্ডেশন, যেমন পাইল ফাউন্ডেশন ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। মজবুত ভিত ভূমিকম্পের জোর ধাক্কা সামলাতে সক্ষম হয়। 

রাজউকের আওতায় থাকা এলাকার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মাটি খারাপ—এসব ভরাট বালু ও মাটি দিয়ে। বাকি ৪০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটি তুলনামূলক ভালো। খারাপ মাটির এলাকাগুলোতে শুধু পাইল দিলে হবে, এমন নয়। আগে মাটির অবস্থার উন্নয়ন করে ভিত মজবুত করতে জোর দিতে হবে। আমাদের কলাম শক্তিশালী তৈরির পাশাপাশি অন্য কাঠামোর সমন্বয় থাকতে হবে; যাতে ভূমিকম্প–সহনীয় হয়।

প্রথম আলো:

ভূমিকম্প–সহনীয় স্থাপনা কেমন হওয়া উচিত এবং নির্মাণে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: ভূমিকম্প–সহনশীল ভবন, ভূমিকম্পের আঘাত সহ্য করে ধসে পড়া থেকে স্থাপনাকে রক্ষা করবে।

ভূমিকম্প–সহনীয় স্থাপনা নির্মাণে যে বিষয়গুলো অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে— 

সঠিক ভূমিকম্প–সহনীয় নকশা: ভবনের নকশা করার সময় দেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি অঞ্চল অনুযায়ী বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ করে সঠিকভাবে ভূমিকম্প–সহনীয় নকশা নিশ্চিত করতে হবে।

কাঠামোয় নমনীয়তা: ভিতকে এমনভাবে নমনীয় বা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে কম্পনের সময় কাঠামোটি ভেঙে না গিয়ে সামান্য দুলতে পারে এবং শক্তি শোষণ
করতে পারে। এ জন্য শেয়ার ওয়াল এবং অন্যান্য ভূমিকম্প–প্রতিরোধী কাঠামো ব্যবহার করা জরুরি।

গুণগত মান: ভবনের যিনি নকশা করবেন, তাঁকে দিয়ে মনিটরিং করানো উচিত। কারণ, নিজের নকশায় নির্মাণ করা ভবনে ঘাপলা রাখবেন না। অন্য কেউ করলে নকশা অনুযায়ী হয় না। এতে নির্মাণে ত্রুটি থেকে যেতে পারে। নকশা অনুযায়ী সঠিকভাবে নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি ভবন নির্মাণে নকশা অনুযায়ী সমস্ত উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।

রেট্রোফিটিং: পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে রেট্রোফিটিংয়ের (ভবন মজবুতকরণ) মাধ্যমে নিরাপদ করতে হবে।

প্রথম আলো:

নির্মাণ উপকরণ, বিশেষ করে রড বা স্টিলের মান ভবন মজবুত করতে কতটা ভূমিকা রাখছে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: ভবন মজবুত করার জন্য রডের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নমানের রড বা নকশা অনুযায়ী সঠিক পরিমাপ বা সঠিক গ্রেডের রড ব্যবহার না করলে ভূমিকম্পের সময় ভবনের কলাম, বিম এবং স্ল্যাব শক্তি শোষণ করতে পারে না, ফলে দ্রুত ফাটল দেখা দেয় এবং ধসে পড়ার আশঙ্কা বাড়ে। উচ্চ প্রসার্য শক্তিসম্পন্ন রড ব্যবহার করা আবশ্যক, যা কম্পনে সম্প্রসারণ ও সংকোচন সহ্য করতে পারে। দেশি কোম্পানিগুলো এখন বিলেট থেকে ভালো মানের রড তৈরি করছে। ভূমিকম্প সুরক্ষায় সব থেকে ৬০ গ্রেড রড ব্যবহার করা ভালো। ৫০০ ডিডব্লিউআর (উচ্চতর শক্তি) রড হলেও ভালো। 

ভবন নির্মাণে কংক্রিটের গুণগত মান ঠিক রাখতে হবে। ছয়তলা পর্যন্ত ভবন তুলতে প্রায় ৩ হাজার পিএসআই (পাউন্ড প্রতি বর্গ ইঞ্চি) বা কংক্রিটের সংকোচন শক্তি থাকতে হবে। আর ১০ তলার ওপরে তুলতে হলে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পিএসআই থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সিমেন্ট, বালু ও পাথরের খোয়ার সঠিক মিশ্রণও কাঠামোর দৃঢ়তা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।

প্রথম আলো:

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড অনুসরণ কি যথেষ্ট? কেন এখনো অনেক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ থেকে যাচ্ছে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: বিএনবিসি একটি চমৎকার এবং বিস্তারিত আইন। এটি অনুসরণ করলে আমাদের ভবনগুলো অবশ্যই ভূমিকম্প–সহনীয় হবে। আইন আমাদের আছে, যা যথেষ্ট। কিন্তু মূল সমস্যা হলো এর প্রয়োগ যথাযথ নয়।

প্রথম আলো:

দেশীয় ডেভেলপার কোম্পানিগুলো নির্মাণে বর্তমানে কতটা ভালো করছে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: যারা সুনাম ধরে রাখতে চায়, তারা অবশ্যই বিল্ডিং কোড এবং গুণগত মান বজায় রাখছে। বর্তমানে ভালো ব্র্যান্ডের আবাসন কোম্পানিগুলো নির্মাণের মান নিশ্চিত করতে কোনো ছাড় দেয় না। এ কারণে অনেক স্থাপনার ভিত্তি এখন ভালো হচ্ছে। কিন্তু অসাধু কিছু ডেভেলপার এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভবন নির্মাতাদের একটি অংশ কোড অনুসরণ করছে না। রানা প্লাজা ধসের পর গার্মেন্টস ভবনগুলো পরীক্ষা করে যেমন ভালো-মন্দ চিহ্নিত করা হয়েছে, তেমনি এখন আমাদের সব আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন পরীক্ষা করা দরকার। ডেভেলপার কোম্পানি ও জনগণকে নিজ উদ্যোগে ভবন পরীক্ষা করে রাজউক থেকে সনদ নিতে হবে। সরকারের উচিত এই প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও বাধ্যতামূলক করা।

প্রথম আলো:

ভূমিকম্প নিয়ে আপনার শেষ অভিমত কী বলবেন?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: ভূমিকম্প কোনো পূর্বাভাস দিয়ে আসে না। তাই আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে।