সাইবার নিরাপত্তা আইন: নামেই বদল, বিষয়বস্তুতে নয়

প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমেছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে।

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। দুটি আইনের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকমের।

এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন, সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের যেসব আপত্তি-উদ্বেগ ছিল, প্রস্তাবিত নতুন আইনেও সেসব দূর করা হয়নি। শুধু কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমেছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়ার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই আইনের মধ্যে পরিবর্তন বলতে প্রথমত শাস্তি কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধের (প্রমাণিত হলে) ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের পরিবর্তে শুধু জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (৩৩ ও ৫৭) প্রস্তাবিত আইনে একেবারে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই দুই ধারায় প্রথমটিতে ‘বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর ইত্যাদির দণ্ড’ সম্পর্কে বলা আছে। আর দ্বিতীয়টিতে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম’ সম্পর্কিত অপরাধের কথা বলা আছে।

এখন যেটা করা হয়েছে, আমার মনে হয় এটি (সাইবার নিরাপত্তা আইন) সাইবার অপরাধ বন্ধ করতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। আর আপনারা (সাংবাদিকেরা) যেসব অভিযোগ করছিলেন, সেই অপব্যবহারও বন্ধ হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
প্রতীকী ছবি

নতুন আইনের খসড়ায় মোট ধারা ৬০টি, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রয়েছে ৬২টি। প্রস্তাবিত আইনে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবারের জন্য যে সাজা, বারবার করলেও একই সাজা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সাজা বেশি রাখার বিধান রয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি করেছিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। এখন প্রস্তাবিত আইনে এ ক্ষেত্রে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধন আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, আগের মতোই রয়ে গেছে। আর দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের আহ্বান জানিয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনে এই দুটি ধারা বাতিল না করে সাজা ও জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে সংস্থাটি যে আটটি ধারা (৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) সংশোধনের কথা বলেছিল, তার ছয়টিতে পরিবর্তন (মূলত সাজা এবং জামিনের ক্ষেত্রে) করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের অনেকে বলছেন, প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানোর বিষয়টি ইতিবাচক হলেও আইনের সংজ্ঞা আগের মতোই বহাল রাখা এবং বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন না আসায় অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সাজা কমানোর কিংবা বাড়ানো কিংবা সাজার মাত্রা পরিবর্তনের ঘটনায় নাগরিকদের অধিকার বা সুরক্ষা হবে না। যেসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষায় খুব একটা কাজে আসবে না।

প্রস্তাবিত আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। এটা অনেকটাই লোকদেখানো। এ ধরনের আইনের মাধ্যমে আমরা নজরদারিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

সম্পাদক পরিষদ গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের চরিত্রগত পার্থক্য না থাকলে শুধু নাম বদল করে নতুন আইন করা অর্থহীন। সংগঠনটি বলছে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদপত্রের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন।

অবশ্য এই আইনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন ‘এখন যেটা করা হয়েছে, আমার মনে হয় এটি (সাইবার নিরাপত্তা আইন) সাইবার অপরাধ বন্ধ করতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। আর আপনারা (সাংবাদিকেরা) যেসব অভিযোগ করছিলেন, সেই অপব্যবহারও বন্ধ হবে।’

আরও পড়ুন

সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের আপত্তি ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার একতরফাভাবে জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছিল। শুরু থেকেই এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাদের উদ্বেগের কথা বলে আসছিল। একপর্যায়ে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও স্বীকার করেন, কিছু ক্ষেত্রে এই আইনের অপব্যবহার হয়েছে।

বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পাঁচ বছর পর সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত সোমবার সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এখন খসড়াটি ভেটিং (আইনি যাচাই) সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবারও তা মন্ত্রিসভায় উঠবে। সরকারের লক্ষ্য, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আইনটি পাস করা।

দুটি ধারা বাতিলের দাবি ছিল, কিন্তু হয়নি

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের কথা বলেছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে আগের মতোই বিষয়বস্তু হুবহু বহাল রাখা হয়েছে। ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। প্রস্তাবিত আইনে শুধু সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড আগের মতোই ১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।

এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন বা ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। প্রস্তাবিত আইনে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতসংক্রান্ত বিষয় রয়েছে। নতুন আইনেও এটি রয়েছে, বিষয়বস্তুর অস্পষ্টতা দূর করা হয়নি।

এই ধারায় অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় হবে।

প্রস্তাবিত সাইবার আইনকে নতুন মোড়কে পুরোনো কালো আইন বলেই মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। এটা অনেকটাই লোকদেখানো। এ ধরনের আইনের মাধ্যমে আমরা নজরদারিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছি।’

উদ্বেগ আগের মতোই রয়ে গেছে

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি অপরাধের বিষয়ে বলা আছে। কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত বিষয়বস্তু একই রেখে সাজা কমিয়ে দুই বছর করা হয়েছে। তবে জরিমানার পরিমাণ একই রাখা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। প্রস্তাবিত নতুন আইনে এই অপরাধের জন্য কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে শুধু জরিমানার শাস্তি রাখা হয়েছে। এখন এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই জরিমানা আছে ৫ লাখ টাকা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো বা ঘটার উপক্রম-সংক্রান্ত অপরাধের কথা রয়েছে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে এই সাজা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। আর অর্থদণ্ড বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে কারাদণ্ড সর্বোচ্চ সাত বছর বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে।

সম্পাদক পরিষদ গতকাল বিবৃতিতে বলছে, ৩২ ধারার মাধ্যমে শাস্তির মাত্রা কিছু কমানো হলেও ঔপনিবেশিক আমলের ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষকে সন্দেহ করত বলে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন জারি করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন থাকার কোনো যুক্তি আছে বলে সম্পাদক পরিষদ মনে করে না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ৮–এর বিষয়বস্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও হুবহু রাখা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে মহাপরিচালকের (ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি) নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে তিনি (মহাপরিচালক) ওই তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো ব্লক (বন্ধ বা বাতিল) করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) অনুরোধ করতে পারবেন।

আর যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রতীয়মান হয় যে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা তার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার জন্য মহাপরিচালকের মাধ্যমে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এসব বিষয়ে অনুরোধ পেলে বিটিআরসি ওই সব বিষয় সরকারকে জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো ব্লক করবে।

৪৩ ধারার বিষয়বস্তু পুরোটাই বহাল

সম্পাদক পরিষদ ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই ধারার (খসড়ায় ৪২ ধারা) বিষয়বস্তু ও সাজার বিষয়টি হুবহু রাখা হয়েছে। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারসংক্রান্ত এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বা সাক্ষ্য–প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে ওই কর্মকর্তা বিশ্বাসের কারণ লিখে ওই স্থানে প্রবেশ করে তল্লাশি এবং প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

এ ছাড়া ওই স্থানে তল্লাশিকালে পাওয়া অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দ করতে পারবেন। এমনকি ওই স্থানে উপস্থিত যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, সন্দেহ হলে গ্রেপ্তার করতে পারবেন।

এ বিষয়ে সম্পাদক পরিষদ গতকাল বিবৃতিতে বলেছে, এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত একধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারাও যেহেতু বহাল থাকছে, তাই নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না।

নতুন আটটি ধারা জামিনযোগ্য হলো

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন ও সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫৩ ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল। এতে অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ আছে। বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ১৪টি। এই ধারাগুলো হলো ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ এবং ৩৪ ধারা। এখান থেকে ৮টি ধারা প্রস্তাবিত আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এগুলো হলো ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারা।

প্রস্তাবিত আইনে নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে জামিনযোগ্য ধারাগুলো হলো: ১৮(১)(খ), ২০, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৬। অন্যদিকে প্রস্তাবিত আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ৬টি। এগুলো হলো: ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩। জামিনযোগ্য ও অজামিনযোগ্য ধারার বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনের ৫২ ধারায় রয়েছে।

অপরাধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন না করায় প্রস্তাবিত আইনেও অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অপপ্রয়োগের জায়গাটি হলো, অপরাধ অনেক ঢালাওভাবে বলা আছে। এর কারণে যার–তার বিরুদ্ধে যেকোনো কিছু বলার জন্য মামলা করা যাবে। পার্থক্য হলো, মামলার পর বিচারে শাস্তি কিছু কম হবে। কিন্তু লেখার কারণে অপরাধ করার যে ভয়, সেই ভয় বিন্দুমাত্র বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। মানহানি, চেতনায় আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া—এগুলোর জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশে কোনো আইন নেই।