যেভাবে পেলাম এসি...

ছবি: সংগৃহীত

গাছের ছায়ার শীতলতা এখন আর তেমন নেই। নাগরিক জীবনে প্রচণ্ড গরমে গাছপালার মাঝে থেকে ঝিরিঝিরি বাতাসের পরশ এখন শুধু কল্পনাতেই! তাহলে বাস্তব জগতে কী? বাস্তবতা হলো, শীতল পরশ এনে দেয় এয়ারকন্ডিশনার বা এসি। শহর ও মফস্‌সলের জীবনযাত্রায় মানুষের গৃহসামগ্রীর প্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে উঠেছে এ যন্ত্র। তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য এসি এখন ঘরের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। তাই এসির শীতল পরশে অজান্তেই এর আবিষ্কারকের প্রতি চলে আসে কৃতজ্ঞতা।

তবে যিনি এসি আবিষ্কার করেছেন, তাঁকে ধন্যবাদ জানালেও তিনি কি আদৌ সেটা গ্রহণ করতেন? কারণ, তিনি তো ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে শীতল পরশ ভোগ করার জন্য এ যন্ত্র আবিষ্কার করেননি। হ্যাঁ, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন খাবার সংরক্ষণ ও ছাপাখানার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা খাদ্যদ্রব্য সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি খুব তাড়াতাড়ি হ্রাস পায়। তাই প্রথমে মূলত ব্যাকটেরিয়া থেকে খাদ্য সংরক্ষণের জন্যই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের ভাবনা আসে।

আধুনিক এসির জনক হিসেবে আমরা জানি আমেরিকান প্রকৌশলী উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ারের নাম। ১৯০২ সালে হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক এসি আবিষ্কার করেন। হ্যাভিল্যান্ড একটি ছাপাখানায় চাকরি করতেন। সেখানকার বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার কারণে কাজের নানা রকম ব্যাঘাত ঘটত। ব্যাঘাত কমিয়ে আরও ভালো করে কাজ করার জন্যই এ যন্ত্রের নকশা করা হয়েছিল। বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ছাপা কাগজের আকার ও কালির ঠিকঠাক ব্যবহার অব্যাহত রাখতে এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। মার্কিন সরকার ১৯০৬ সালে এসির জন্য তাঁকে পেটেন্ট প্রদান করেন।

এর আগে রেফ্রিজারেশন নীতি আবিষ্কারের ফলে ১৮২৪ সালে তরল অ্যামোনিয়া বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বাতাসকে শীতল করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। পরে ১৮৪০ সালে পদার্থবিদ ও চিকিৎসক জন গরি মতামত দেন, ম্যালেরিয়ার মতো বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের একমাত্র সমাধান হতে পারে এই শীতলীকরণ পদ্ধতি। উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে ফ্লোরিডার শহরগুলোকে শীতল করার ধারণা প্রস্তাব করেন এই চিকিৎসক। জন গরি কমপ্রেশার ব্যবহার করে রেফ্রিজারেটর তৈরি করেন, কিন্তু তিনি পেটেন্ট নিতে ব্যর্থ হন। ফলে বেশ কিছু বছর থমকে ছিল কৃত্রিম শীতলীকরণ এই ব্যবস্থার কাজ।

১৯১৫ সালে হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার ও ছয় প্রকৌশলী মিলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এসি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে ঘরবাড়িতে এসির ব্যবহার শুরু করতে দেখা যায়। সেই সময়ে এই শীতলীকরণ যন্ত্রে অ্যামোনিয়া, প্রপেন ও মিথাইল ক্লোরাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করা হতো। টমাস মিগলি জুনিয়র ১৯২৮ সালে ফ্রেয়ন আবিষ্কার করেন। এর মাধ্যমে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে মানুষের জন্য নিরাপদ এসি আবিষ্কার করা হয়।

১৯০২ সালে উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার উদ্ভাবিত এসি এতটাই আকৃতিতে বড় ছিল যে এই এসি রাখতেই একটি ঘরের প্রয়োজন হতো। এ কারণে বড় বড় কারখানা ছাড়া এই এসি তেমন একটা ব্যবহার করা যেত না। তবে কবে থেকে শুরু হলো পোর্টেবল এসি? ১৯৪৫ সালে রবার্ট শেরম্যান এই পোর্টেবল এসি আবিষ্কার করেন, যা জানালার পাশে রেখে ব্যবহার করা যেত। এই এসি ঘরের বাতাসকে ফিল্টার করত। সেই সঙ্গে গরমের দিনে ঘর ঠান্ডা রাখত এবং শীতের দিনে ঘর গরম রাখত। হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর মারা যান। আমেরিকার ইউনাইটেড টেকনোলজিস ১৯৭৯ সালে ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কিনে নেয়।

এই যে আমরা এখন ঘরে ঘরে এসি ব্যবহার করি, এটার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। সে বছর ৩০ হাজার এসি উৎপাদন করা হয়। এবং ১৯৫৩ সালে তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

প্রযুক্তির উন্নতির ধারাবাহিকতায় প্রতিবছরই উৎপাদন বেড়েছে এসির। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির নানা ধরনের এসি। যেটির সুফল ভোগ করছেন এখন প্রতিটি দেশের মানুষ।

ওয়েবসাইট অবলম্বনে