বাড়িতে প্রসব, প্রাণ যাচ্ছে মা-শিশুর

সাফজয়ী নারী ফুটবলারের মৃত্যুর পর বাড়িতে সন্তান প্রসবের উচ্চ হার, প্রসবপূর্ব সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতার মতো বিষয় সামনে এসেছে।

স্থানীয় মানুষের কাছে মোসাম্মৎ আলফা বেগম (২২) ‘বোকা’ হিসেবে পরিচিত। শ্বশুরবাড়ির মানুষের ভাষায়, আলফা এতই ‘বোকা’ যে সন্তান প্রসবকালে শারীরিকভাবে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি বোঝেননি। ফলে সময়মতো প্রসব না হওয়ায় তাঁর সন্তান মারা গেছে।

গত ১৭ এপ্রিল বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা শিমুলতাইড় চরে গিয়ে কথা হয় আলফা ও তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে। এক প্রশ্নের জবাবে আলফার ননদ মোসাম্মৎ রাবেয়া বেগম স্বীকার করেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আলফাকে কখনো চিকিৎসক দেখানো হয়নি।

উপজেলা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যমুনা নদী পেরিয়ে দুর্গম চরাঞ্চলের শিমুলতাইড় চর গ্রামে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লেগেছিল। গ্রামটিতে ১০০ পরিবারের বাস। বাসিন্দারা বলছেন, বাল্যবিবাহ ও অল্প বয়সে গর্ভধারণ সেখানে স্বাভাবিক বিষয়। বাড়িতে স্বাভাবিক প্রসবই সেখানে ভরসা। প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে দেড়–দুই ঘণ্টা পথ পেরিয়ে সোনাতলা অথবা সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়।

আলফার সন্তানের মৃত্যুর দিন বিশেক আগে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীনাথপুরে বাড়িতে সন্তান প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে গত ১৪ মার্চ ভোরে মারা যান সাফজয়ী নারী ফুটবল খেলোয়াড় রাজিয়া সুলতানা (২১)। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে নতুন করে আলোচনায় আসে বাড়িতে সন্তান প্রসবের উচ্চ হার, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও পরিবারের অসচেতনতা, সরকারি উদ্যোগের অভাব, প্রসবপূর্ব অন্তত চারবার সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতার মতো বিষয়।

মা ও শিশুমৃত্যুর এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আজ ২৮ মে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘হাসপাতালে সন্তান প্রসব করান, মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচান’।

চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩–এর গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল’ প্রতিবেদন অনুসারে, এখনো বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। চারবার বা ততধিক প্রসবপূর্ব সেবা নেওয়ার হার মাত্র ৩৯ শতাংশ। প্রতি হাজার জীবিত শিশু জন্মের বিপরীতে এক মাসের কম বয়সী বা নবজাতক মারা যাচ্ছে ২০ জন। প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান ১৩৬ মা।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখে ৭০ ও নবজাতকের মৃত্যু প্রতি হাজারে ১২ জনের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালসহ মোট ৫৮৬টি সরকারি হাসপাতালে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৬০ নবজাতক ও ২৪২ মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালে ৬ হাজার ৯৮০ নবজাতক ও ৮৭৫ মায়ের এবং ২০২২ সালে ১০ হাজার ৫৩৩ নবজাতক ও ৮০০ মায়ের মৃত্যু হয়েছে।

উদাসীনতা

টিনের চালা আর বেড়ার ছোট্ট ঘরে বসে কথা হচ্ছিল আলফা, তাঁর ননদ ও দেবরের সঙ্গে। আলফা বেগম গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। তাঁর ননদ রাবেয়া বললেন, আলফা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাঁর ভাই মো. সুলতান শেখ বাক্‌প্রতিবন্ধী। এটা ছিল তাঁর প্রথম গর্ভধারণ। ধাত্রী প্রসবের চেষ্টা করেন। শিশুর মৃত্যুর জন্য ভাবিকে দায়ী করে ননদ বলেন, শিশু জন্মদানের জন্য শারীরিকভাবে সাড়া দিতে পারেননি তাঁর ভাবি। ব্যথা বাড়লে বারবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। প্রসবকালে হাসপাতালে নেননি কেন জানতে চাইলে রাবেয়া বলেন, ‘সেটা ভুল হয়েছে।’

চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই গ্রামের মানুষ ততটা সচেতন নয়। জটিল স্বাস্থ্যসেবা দরকার হলে নৌকা, ঘোড়ার গাড়ি ও কখনো অটোরিকশায় ঘোরা পথে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছাতে হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান শিখা গাঙ্গুলি প্রথম আলোকে বলেন, মা ও শিশুর জীবনের ঝুঁকি কমাতে অন্তত চারবার প্রসবপূর্ব সেবা নিতে হয়। প্রতিটি গর্ভধারণ আলাদা। তাই প্রসবের আগপর্যন্ত কার ক্ষেত্রে কী অবস্থা হবে, তা অনুমান করা যায় না। ফলে বাড়িতে প্রসব খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতায় ৩ হাজার ২৮৮টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র; জেলায় ৬০টি, উপজেলায় ১২টি ও ইউনিয়নে ১৪৭টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। তবে এগুলোর কোনোটিতে গাইনি ও অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক নেই।

 পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মানুষকে সেবাকেন্দ্রমুখী ও চারবার প্রসবপূর্ব সেবা নিতে সচেতন করতে এবং অবকাঠামোগত ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার কাজ করছে।