‘চোখে দেখেন না, বাইরে বের হইছেন কেন’

নাহিয়ান বুশরা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

নাহিয়ান বুশরা জন্মের পর মাত্র এক বছর চোখে দেখেছেন। মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে চোখের অপটিক নার্ভ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর দেখতে পাননি। এখন দুই চোখের সামনে আবছা আলো-ছায়া দেখতে পান; যা কোনো কাজে লাগে না। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা তাঁর গলার সুর দমিয়ে রাখতে পারেনি। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী তিনি।

বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, ছায়ানটের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে নাহিয়ানের পরিচিতি বেড়েছে। হতে চান দেশের প্রতিষ্ঠিত ‘প্লেব্যাক সিঙ্গার’। গানের পাশাপাশি নারী, প্রতিবন্ধী নারীসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার কাজে যুক্ত নাহিয়ান একজন উদ্যোক্তাও হতে চান। আরও চান মানুষের মনের যত্ন বিষয়ে কাজ করতে।

নাহিয়ান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য পরিচালিত ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাস করেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হিসেবে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন।

নাহিয়ান বললেন, সমাজে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। তারপরও ভবনগুলোতে র‍্যাম্প নেই। লিফটের অডিও বন্ধ থাকে। ভাঙা ফুটপাতে হাঁটার অবস্থা নেই।

২০১৯ সালে পড়াশোনা শেষ হয় নাহিয়ানের। দেশে মানসিক বা মানবিক অস্থিরতা বেড়ে চলার পরিপ্রেক্ষিতে রেজিলিয়েন্ট স্পিরিটস অ্যালায়েন্স নামের সংগঠন গড়ে তুলেছেন তিনি। মানসিক বা মানবিক বিপর্যয় কেন ঘটছে, সাধারণ মানুষের জীবনে তা কেমন প্রভাব ফেলছে, এসব নিয়ে গবেষণা করা এর উদ্দেশ্য। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছেন ইমরুল হাসান নামের এক ছোট ভাই। কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরাও।

এ ছাড়া বহ্নিশিখা, ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক সংগঠন সিবিএমসহ বিভিন্ন সংস্থায় নাহিয়ান কাজ করেছেন বা যুক্ত আছেন।

প্রেমিকের মতো মনে হয় গানকে

নাহিয়ান বললেন, তাঁর জীবনের সব কাজ একদিকে আর অন্যদিকে শুধু গান। এই গানের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। গানকে প্রেমিকের মতোই মনে হয় এবং এর মাধ্যমে তিনি আধ্যাত্মিক কিছুর সঙ্গেও নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন বলে জানান তিনি।

নাহিয়ান জানালেন, তিন বছর বয়স থেকে তিনি গানের তালিম নেওয়া শুরু করেন। আবদুস সাত্তার, ফিরোজা বানুর কাছে ছোটবেলায় গান শিখেছেন। ছায়ানটের শিশুশ্রেণি থেকে শুরু করে সমাপনী কোর্স সমাপ্ত করেছেন।

মায়ের সঙ্গে নাহিয়ান বুশরা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

দেশের নজরুলসংগীতের গুণী শিল্পী সুজিত মোস্তফা বুশরার গানের একটি ভিডিও পোস্ট করে ফেসবুকে লিখেছেন, নাহিয়ান বুশরা ২০১৯ সাল থেকে তাঁর কাছে গান শিখছেন। দৃষ্টিশক্তি না থাকা বুশরা খুব ভালো ছাত্রী বলে পোস্টে উল্লেখ করেন তিনি।

গান নিয়েই সামনে এগোতে চান নাহিয়ান। তবে বাণিজ্যিক শিল্পী নয়, একজন খাঁটি সংগীতশিল্পী হিসেবেই পরিচিতি পেতে চান। গানের চর্চার পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও জীবনী নিয়ে গবেষণা করতে চান নাহিয়ান।

‘বাবা-মা না থাকলে জার্নিটা ভয়াবহ হতো’

এ সমাজে নারীদের কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। সঙ্গে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা যোগ হওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বেড়েছে নাহিয়ানের জীবনে। তবে ছোটবেলা থেকে বাবা-মাকে পাশে পাওয়ায় সহজেই সেসব উতরে গেছেন। নাহিয়ান বললেন, ‘আমার পাশে বাবা-মা না থাকলে আমার জার্নিটা ভয়াবহ হতো। অনেক বাজে মন্তব্য শোনা থেকে নিস্তার পেয়েছি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলের জন্যও বন্ধু, শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছি।’

লোকজন নাহিয়ানকে যে একেবারেই নাজেহাল করেননি, তা বলার উপায় নেই। নাহিয়ানের ভাষায়, ‘মানুষের বাজে আচরণ বা বাজে কথা প্রায়ই প্রকাশ হয়ে যেত। এক পা বাড়ানোর আগেই নিজেকে প্রমাণ করতে হতো যে কাজটা করতে পারি বা ভুল জায়গায় পা দিচ্ছি না।’

নাহিয়ান বললেন, ‘আমি গান গাই, এটা নিয়ে কথা না বললেও মানুষ জানতে চান, আমি খাই কীভাবে? গোসল করি কীভাবে? ব্যক্তিগত সব কাজ নিজে করতে পারি কি না, বিয়েই-বা কেন করছি না? এসব প্রশ্ন থেকে রেহাই মেলে না।’

মায়ের সঙ্গে নাহিয়ান বুশরা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

নাহিয়ানকে হুট করে দেখে অনেকেই বুঝতে পারেন না, তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। বাজে অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে নাহিয়ান বলেন, ‘স্কুল-কলেজে বাবা-মা নিয়ে যেতেন, নিয়ে আসতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একা চলাফেরা করার চেষ্টা করি। একবার বেইলি রোড থেকে ধানমন্ডি যাব, উবার ঠিক করলাম। ধানমন্ডিতে সেদিনই প্রথম যাচ্ছি বলে কিছু চিনি না। চালককে বললাম, লোকেশন অনুযায়ী যান। চালক জানালেন, তিনি অ্যাপের মাধ্যমে ম্যাপ দেখা, কোনো জায়গায় যাওয়া—এসব পারেন না। আমাকেই চিনিয়ে নিয়ে যেতে বললেন। বললাম, আমি চোখে দেখি না। চালক ক্ষেপে বললেন, “চোখে দেখেন না, বাইরে বের হইছেন কেন?”’

শুধু এই উবারচালক নন, অনেকেই বলেন, ‘এত প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বের হয়েছেন কেন?’ এমন একটা ভাব, চোখে দেখতে না পাওয়া বিরাট অপরাধ, বলেন নাহিয়ান।

নাহিয়ান বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে গানের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বললেন, ‘এখন গান শোনার চেয়ে দেখার বিষয় হয়ে গেছে। ফলে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেখানে কর্মরতরা দ্বিধায় পড়ে যান, আমি ভিডিওতে ভালো করে তাকাতে পারব কি না, দেখতে ভালো দেখা যাবে কি না। অনেকে এসব চিন্তা করে ডাকতে চান না।’

আরও পড়ুন

জীবনটাই চ্যালেঞ্জিং, চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে

নাহিয়ান বললেন, সমাজে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। তারপরও ভবনগুলোতে র‍্যাম্প নেই। লিফটের অডিও বন্ধ থাকে। ভাঙা ফুটপাতে হাঁটার অবস্থা নেই।

‘জীবনটাই চ্যালেঞ্জিং, তাই চ্যালেঞ্জ তো নিতেই হবে। ভাইয়েরা আমি বাইরে গেলে অস্থির হয়ে পড়ে, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, সে ভয়ে। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার জন্য তো ঘরে বসে থাকা যাবে না’, বলেন নাহিয়ান।

পরিবারের সঙ্গে নাহিয়ান বুশরা
ছবি: সংগৃহীত

২৮ বছর বয়সী নাহিয়ান বিয়ের চিন্তাভাবনা করছেন কি না, জানতে চাইলে হেসে জানালেন, একসময় ভেবেছিলেন করবেন না। তবে জীবনে চলার পথে একজন সঙ্গী দরকার, তাই বিয়ের কথা ভাবছেন। জীবনসঙ্গী তাঁকে সম্মান করবেন কি না, তাঁকে বিশ্বাস করা যায় কি না, মানসিকতা কেমন, বন্ধু হয়ে পাশে থাকতে পারবেন কি না—এসব দেখেই বিয়ের দিকে এগোবেন। জানালেন, হয়তো শিগগিরই এ নিয়ে কোনো সুখবরও দিতে পারবেন।

অন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারীদের জন্য কোনো পরামর্শ আছে কি না, জানতে চাইলে নাহিয়ান বললেন, নিজের মনকে কখনোই দুর্বল করে রাখা যাবে না। মনের জোরে একবার উঠে দাঁড়াতে পারলে, কেউ আটকে রাখতে পারবে না। নারীদের আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তার জন্য সাদাছড়ির ব্যবহার করতে হবে। সাদাছড়ি গৌরবের প্রতীক, এটা দেখে অন্যরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। তাই সাদাছড়ি ব্যবহারে লজ্জা পেলে চলবে না।

নাহিয়ান জানালেন, রাস্তায় অনেক সময় রাস্তা পার করে দেওয়ার সময় বা অন্য কোনো কাজে সাহায্য করার সময় অনেকে গায়ে হাত দেন। কোন স্পর্শ ভালো, আর কোন স্পর্শ খারাপ, তা বুঝতে না পারার তো কথা নয়। তাই আইনকানুন যতই থাকুক, যত দিন মানুষের দৃষ্টিগত ও আচরণগত পরিবর্তন না হবে, তত দিন প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতিবন্ধকতা পিছু ছাড়বে না।

আরও পড়ুন