সেই জ্যোতিষ্মান মানুষেরা

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার যাত্রা শুরু ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে, দেশের রাজনীতি যখন উত্তাল। কিন্তু সেই সময়টাতে কেউ ভাবতেও পারেনি, সবচেয়ে আশাবাদী সংগ্রামীও না যে মাত্র আড়াই বছর পর আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এই আড়াই বছর রাজনীতি আর শিক্ষা এক অবাক সমীকরণের ভারসাম্য মেনে চলেছে। সবচেয়ে সংগ্রামমুখর দিনেও আমরা ক্লাসে গিয়েছি, ক্লাস শেষে পথে নেমেছি, মিছিলে-স্লোগানে শাসকের মনে ভয় ধরিয়েছি। আমাদের শিক্ষকেরা নিশ্চয়ই জানতেন, একদিন অস্তিত্বের লড়াইটা শুরু হবে। সেই লড়াইয়ে নামতে হলে শুধু অস্ত্র থাকলে চলবে না, থাকতে হবে জ্ঞানের শক্তি, শিক্ষার আলোকসঞ্চারী ক্ষমতা। তাঁরা শ্রেণিকক্ষে তাই শুধু পাঠ দিতেন না, অস্তিত্বের লড়াইয়ের জন্য আমাদের তৈরিও করতেন। ইংরেজি বিভাগে আমি যেসব শিক্ষককে পেয়েছিলাম, তাঁরা প্রত্যেকেই সেই কাজ করতেন; এবং করতে গিয়ে তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই শত্রুর জিঘাংসার নিশানা হয়েছিলেন। শত্রুরা যদি আর দুটি নির্বিবাদ মাস সময় পেত আত্মসমর্পণের আগে, তাহলে তাঁদের কেউ বেঁচে থাকতে পারতেন কিনা সন্দেহ।

শিক্ষকেরা কেন শত্রুর নিশানা হয়েছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তিনটি বিষয় সামনে আসে: এই শিক্ষকেরা সবাই ছিলেন আলোকসঞ্চারী। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকালে তাঁরা স্বাধীনতার প্রশ্নে অভিন্ন একটা অবস্থানে থেকে নিজেদের কাজটি করে গেছেন। তাঁরা ছিলেন জাতির, বিবেকের, সংস্কৃতির, স্বপ্নের কণ্ঠস্বর। তাঁরা প্রথাগত রাজনীতিতে ছিলেন না; কিন্তু ছিলেন সেই রাজনীতিতে, যা ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করে একটি জাতির মেধা ও মনন, রুচি ও মেজাজ এবং তার সৃজনশীলতার ও প্রকৃষ্ট সব চর্চার ভূমি গড়ে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্য বলার মতো সাহস তাঁরা রাখতেন এবং শিক্ষার্থীদেরও সেই সাহস জোগাতেন। এ জন্যই তাঁরা ক্ষমতার বিরাগভাজন হয়েছেন।

আমার বিভাগে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম রাশীদুল হাসান স্যারকে, যিনি তাঁর কবিসত্তাকে মেলে ধরতেন পাঠদানে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই হারিয়ে যাওয়া ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা সাহিত্যকে অবলীলায় জীবনে ছড়িয়ে দিতে পারতেন। তিনি ছিলেন প্রসন্নচিত্ত আর জীবনানন্দের স্বরূপ। আমার সাবসিডিয়ারি বিষয়ের মধ্যে ছিল ইতিহাস। দুই শহীদ শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এবং সন্তোষ ভট্টার্চাযের কাছে আমি ইতিহাসের পাঠ নিয়েছি। গিয়াসুদ্দিন স্যার ছিলেন একাগ্রচিত্ত একজন শিক্ষক, জ্ঞানচর্চা কতখানি আকর্ষণীয় হতে পারে, তাঁর ক্লাসে সেটি দেখেছি। সন্তোষ স্যার ছিলেন ধীরস্থির, নমিত স্বভাবের মানুষ। তাঁর কাছে পাঠদান ছিল সতত আনন্দের একটি বিষয়। বাংলার শিক্ষক মুনীর চৌধুরীকে ক্যাম্পাসের সবাই জানত বাগ্মী এবং চৌকস শিক্ষক হিসেবে, আর তাঁর নাট্যকার পরিচিতিটা তো ছিলই। লুকিয়ে তাঁর ক্লাস করেছি, ধরা পড়ে তিরস্কারের পরিবর্তে প্রশ্রয় পেয়েছি। ড. জিসি দেবের সঙ্গে অনেক কুণ্ঠা নিয়ে পরিচিত হয়েছি, হবিগঞ্জের সন্তান হিসেবে। তিনি পিঠে হাত রেখে প্রসন্ন হাসিতে কুণ্ঠাকে দাবিতে পরিণত করেছেন। ‘যখন খুশি আসবে’ তিনি বলেছেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই ‘যখন খুশি’ নানা কারণে মাত্র বার পাঁচেকের বেশি গড়ায়নি। তিনি দর্শনের অধ্যাপক শুধু ছিলেন না, ছিলেন দার্শনিকও। তাঁর সঙ্গে কথা বলা আর মনটাকে আরেকটু গভীর করা ছিল একই কথা।

এই জ্যোতিষ্মান শিক্ষকদের কথা ভাবতে বসলে মনে হয়, ষাটের দশকটা সত্যিই একটা সোনালি সময় নিয়ে এসেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্বটি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু কী যে ছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয়! বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ছিল রাজনীতিতে সমর্পিত; কিন্তু সেই রাজনীতিকে শক্তিশালী করত শিক্ষা আর সংস্কৃতি চর্চার যুগ্ম স্রোত; এবং তাদের পথ দেখাতেন নিষ্ঠাবান, সংস্কৃতি আর শিক্ষার শক্তিতে অবিচল শিক্ষকেরা। সেই সময়টা আর ফিরে আসেনি। কোনোদিন আসবে, তেমন সম্ভাবনাও দেখতে পাই না।

আমরা এই আদর্শ শিক্ষকদের বছরের মাত্র একটি দিন শুধু স্মরণ করি; আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাঁদের দেখানো পথে জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা আর দেশভাবনাকে সাজানোর চেষ্টা করে না। এ জন্যই কি না, এখন আর তাঁদের মতো নিঃস্বার্থ, দেশ ও শিক্ষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক খুব বেশি চোখে পড়ে না। কেন—এই প্রশ্নটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

প্রতিবছর এই ধারণা আমার আরও দৃঢ় হয়—এই জ্যোতিষ্মান শিক্ষকেরা না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার পথটা বড় বন্ধুর হয়ে যেত। তাঁরা এবং দেশজুড়ে শহীদ শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা আলো জ্বেলে দাঁড়িয়েছিলেন, যাতে তা না হয় যেন পথ চিনে এগোনো যায়।

এখনো তাঁরা আলো হাতে দাঁড়িয়ে—আমাদের ভবিষ্যৎ যাত্রার পথটি আলোকিত রাখার জন্য।

তাঁদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষাবিদ