মেডিকেল নথিতে গুলি, পুলিশ বলছে ইটের আঘাত

শহিদুল ইসলাম

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের সময় গুলিতে নয়, ইটের আঘাতে যুবদল কর্মী শহিদুল ইসলাম ওরফে শাওনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার দুপুরে মুন্সিগঞ্জ পুলিশ সুপারের সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ মাহফুজুর রহমান আল মামুন এ দাবি করেন।

অথচ আহত অবস্থায় শহিদুলকে হাসপাতালে নেওয়ার পর বলা হয়েছিল, গুলির কারণে তাঁর মস্তিষ্কে ক্ষত হয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর সংঘর্ষের ঘটনায় আহত শহিদুলকে ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, আইসিইউর নিবন্ধন খাতায় লেখা হয়েছিল, ‘ব্রেন ইনজুরি-গান শুট (গুলিতে মস্তিষ্কে ক্ষত)।’ পরের দিন শহিদুলের মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেওয়া মেডিকেল সনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘গুলির কারণে মস্তিষ্কে গুরুতর ক্ষত।’

শহিদুলের মৃত্যুর ছয় দিন পর গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ মাহফুজুর রহমান আল মামুন বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর পুলিশের ওপর বিএনপির নেতা-কর্মীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে যুবদল কর্মী শাওন ও তাঁর সঙ্গে থাকা বিএনপির অপর এক কর্মীর পেছন থেকে ছোড়া ঢিলে আঘাত পান। তাঁকে আত্মীয়স্বজন চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। পরদিন রাত নয়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।

তবে নিহত শহিদুলের মা লিপি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা বলছে আমার ছেলে ইটের আঘাতে মারা গেছে, তারা ওই ভিডিওটি দেখুক, যেখানে গুলির শব্দ হলো, ধোঁয়াও বের হলো, তখন আমার ছেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাসপাতালের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, গুলির আঘাতে শাওন মারা গেছে। অথচ তারা সেই রিপোর্টকে মিথ্যা বলছে।’

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে শহিদুলের মরদেহের সুরতহাল সম্পন্ন করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। অতঃপর ফরেনসিক বিভাগ লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে ভিসেরা পরীক্ষা করে। ভিসেরা পরীক্ষায় কোনো বিষ নেই মর্মে মতামত দেওয়া হয়। সুরতহাল ও ভিসেরা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মাথায় আঘাতের কারণে শাওনের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাথার পেছনে থেঁতলানো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া গান শুটের কোনো আঘাত নেই। ইটের আঘাতেই শাওনের মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, শহিদুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিষয়টি আদালতে জানিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। নিহত শহিদুলের পরিবারকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। শাওনের পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হবে।

নিহত শহিদুল মুন্সিগঞ্জ উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা এলাকার ছোয়াব আলীর বড় ছেলে। তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক ছিলেন। পাশাপাশি মিরকাদিম পৌরসভা ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের কর্মী হিসেবে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।

গত মঙ্গলবার এক প্রশ্নের জবাবে শহিদুলের মা লিপি আক্তার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার একটা ছেলে গেছে। আমার আরও তিনটা ছেলে আছে। আমার স্বামী আছে। আমি তাদের হারাতে চাই না। আমি নিরাপত্তা চাই। কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যারা হুমকি দিচ্ছে, আমরা তাদের চিনি না। যারা হুমকি দিচ্ছে, তারা বলছে, আমার ছেলে পুলিশের গুলিতে মরে নাই। আমার ছেলে ইটের আঘাতে মারা গেছে। তারা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা পাল্টে ইটের আঘাতে মারা গেছে—এমন মামলা দিতে বলছে। আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছে।’

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দলীয় নেতা-কর্মী হত্যার প্রতিবাদে মুন্সিগঞ্জ শহরের পাশে মুক্তারপুরে ২১ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটার দিকে বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করে জেলা বিএনপি। সেখানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে শাওন ও বিএনপির সমর্থক জাহাঙ্গীর মাদবর (৩৮) গুরুতর আহত হন। পরের দিন রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাওনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুটি পৃথক মামলা হয়। এসব মামলায় বিএনপির ১ হাজার ৩৬৫ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। দুটি মামলায় ২৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।