ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেশি
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা, সাভার ও গাজীপুরে আরও অন্তত ছয়টি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে গতকাল বুধবার রাত পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গাজীপুরে সাত ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
এ নিয়ে গত তিন দিনে সারা দেশে অন্তত ১৭টি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল। এর মধ্যে ১৬টি ঘটনা ঘটেছে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় (সাভার ও গাজীপুর)। বাসে আগুনের ঘটনায় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় একজনের মৃত্যুও হয়েছে। এর বাইরে গতকাল রাত সাড়ে নয়টার দিকে তেজগাঁও রেলস্টেশনে ট্রেনের একটি পরিত্যক্ত বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
বাসে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং কারওয়ান বাজার এলাকায় ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এ নিয়ে গত তিন দিনে ঢাকার অন্তত ২২টি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল।
এর বাইরে গতকাল গাজীপুরের কালীগঞ্জের গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের একটি রিসোর্ট থেকে দুটি পেট্রলবোমা উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে গ্রামীণ ব্যাংকের চান্দুরা শাখায় জানালার কাচ ভেঙে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করার কথা রয়েছে। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সাবেক আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন (অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী)। এদিন আওয়ামী লীগ অনলাইনের মাধ্যমে লকডাউন কর্মসূচি ডেকেছে।
এরই মধ্যে গত তিন দিনে একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কখনো যাত্রীবেশে, কখনো সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে, আবার কখনো মোটরসাইকেলে এসে এসব চোরাগোপ্তা হামলা করছে দুর্বৃত্তরা। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গতকাল ঢাকায় অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের চেয়ে যানবাহন চলাচল কম ছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কথিত লকডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কয়েক দিন ধরে ঢাকায় ককটেল বিস্ফোরণ এবং আগুনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
তিন দিনে ১৭ বাসে আগুন
ঢাকাসহ সারা দেশে চোরাগোপ্তা হামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ঢাকা ও আশপাশে। গত তিন দিনে যে ১৭টি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, এর মধ্যে ১৬টি ঘটেছে ঢাকা, সাভার ও গাজীপুরে।
গতকাল সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে রাজধানীর দোলাইরপাড় মোড়ে একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর আগে দুপুরে ঢাকার শাহ আলী থানা এলাকায় একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম আযম প্রথম আলোকে বলেন, মিরপুর-২ নম্বরের দিক থেকে সনি সিনেমা পেরিয়ে নিউমার্কেটের দিকে যাওয়ার পথে যাত্রীবেশে থাকা তিন ব্যক্তি বাসটিতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানো হয়।
গতকাল ভোর সাড়ে চারটার দিকে গাজীপুরের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ভোগরা এলাকায় ভিআইপি পরিবহনের একটি বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে শ্রীপুরে পেট্রলপাম্পের পাশে পার্ক করে রাখা একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
এর আগে মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে কালিয়াকৈর-নবীনগর মহাসড়কের গাজীপুর মহানগরীর চক্রবর্তী এলাকার জ্যোতি ফিলিং স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুই যুবক মোটরসাইকেলে এসে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়।
সাত ঘণ্টায় তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগের পর গাজীপুর জেলা পুলিশ ও গাজীপুর মহানগর পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় চৌকি বসিয়ে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করছে।
গতকাল ভোরে সাভারের আশুলিয়ায় একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ওই সময় বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলেন চালক মো. সাত্তার। তিনি জানালা দিয়ে লাফিয়ে বের হয়ে প্রাণে বেঁচেছেন বলে জানান।
গত মঙ্গলবার গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে গ্রামীণ ব্যাংকের চান্দুরা শাখায় জানালার কাচ ভেঙে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে আসবাব ও কাগজপত্র পুড়ে গেছে। তবে ভল্টের টাকা লুট বা বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ঢাকায় দুই দিনে গ্রেপ্তার ৯৪
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দলটি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত শুধু ঢাকা থেকে ৪৪ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে ডিএমপি। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডিএমপির একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বাসে আগুন দেওয়া ও পেট্রলবোমা বিস্ফোরণের নির্দেশনা আসছে বিদেশ থেকে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের কার্যক্রমের তদারক করছেন বিদেশে পলাতক আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় অনেক নেতাও রয়েছেন।
হোটেলে-মেসে অভিযান, চৌকি বসিয়ে তল্লাশি
‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে দুই দিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার হোটেল ও মেসে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। গতকাল রাতেও ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, পল্টন, কাকরাইল, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার মেসে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।
গতকাল দিনে এবং রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চৌকি বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সেনাবাহিনীকেও বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালানোর পাশাপাশি সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে তল্লাশি করতে দেখা গেছে।
গতকাল বেলা একটার দিকে সচিবালয় এলাকায় পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে। সচিবালয়ের আশপাশে সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময়ও অনেক মানুষ তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছেন।
ডিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রবেশমুখগুলোর ১১টি পয়েন্টসহ মোট ৮৩টি তল্লাশিচৌকি বসানো হয়েছে। ঢাকায় সাধারণত ১৫ থেকে ১৭টি স্থায়ী তল্লাশিচৌকি থাকে। এ ছাড়া ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ টহলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। রাজধানীবাসীর নিরাপত্তায় ৩৩৭টি পিকেট টিম (গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নিয়ে দায়িত্ব পালনকারী দল) বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করবে। সংখ্যার হিসাবে ১৭ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য নিরাপত্তায় মাঠে রয়েছেন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গণসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকা ও আশপাশের জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বলেছে, ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় র্যাবের ৭০টির বেশি টহল দল সার্বক্ষণিক কাজ করছে। এ ছাড়া গত মঙ্গলবার দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার
ডিএমপির কর্মকর্তারা জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, জাজেস কমপ্লেক্স, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটক, মাজার ফটক, জামে মসজিদ ফটক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ ও ২-এর প্রবেশ ফটক, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ভবন এলাকাগুলো স্পর্শকাতর বিবেচনা করে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এসব এলাকায় এরই মধ্যে সব ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব এলাকার পাশাপাশি জাতীয় প্রেসক্লাব, সচিবালয়, জিরো পয়েন্ট, পল্টন, কাকরাইল, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
পুলিশের চিহ্নিত করা স্পর্শকাতর এলাকাগুলোর বেশির ভাগই ডিএমপির রমনা বিভাগের অধীনে। এই বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন স্থানে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি টহল দলগুলো সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে। এ ছাড়া গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করে সেটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং চোরাগোপ্তা হামলা প্রতিরোধ করা।