বাবা-মা না থাকলে ওদের দেখবে কে

মা মারুফা হোসেনের সঙ্গে আফিয়া কবীর আনিলাছবি: সংগৃহীত

নশিন সাইয়ারা খানের মা আফরোজা খান গত ২২ মার্চ ব্রেন টিউমারে মারা যান। ২৬ বছর বয়সী অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নশিনের বাবা মো. আবদুর রব খান বলেন, মেয়ের মা মারা গেছেন, মেয়ে হয়তো এটাও বুঝতে পারছে না। কারণ, মেয়ের জগৎ তো অন্যদের থেকে আলাদা।

আবদুর রব খান বলেন, ‘কালকে আমি মারা যেতে পারি। তখন এই মেয়েকে কে দেখবে, এই চিন্তা সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। মেয়ে বাচ্চা (শিশু) হলে তো আরও বেশি চিন্তা। আমরা কেউ যখন থাকব না, তখন এই বাচ্চারা একটু সুস্থভাবে যাতে বেঁচে থাকতে পারে, সে ধরনের একটি আবাসিক ব্যবস্থা বা পুনর্বাসনকেন্দ্র থাকলে একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম।’

আবদুর রব খান বললেন, আফরোজা অসুস্থ থাকায় নশিনের দেখভাল করতে পারছিলেন না। তাই তিনি চার মাস আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এখন এই স্ত্রী নশিনকে দেখে রাখবেন বলে প্রত্যাশা তাঁর। আবদুর রব খানের আরেক মেয়ে আছে। নশিনের এই ছোট বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।

অটিস্টিক, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি আছে—এমন সন্তানের কয়েকজন মা-বাবার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। এই বাবা-মায়েদের কথায় একটা দুশ্চিন্তা ঘুরেফিরে আসতে দেখা গেল। তা হলো, তাঁদের অবর্তমানে সন্তানকে কে দেখে রাখবে। বয়স বাড়লেও এ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজের চাহিদার কথা বলতে পারেন না। অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন না। তাই মা-বাবার অবর্তমানে তাঁদের মতোই আগলে রাখবে—এমন প্রতিষ্ঠান ও দক্ষ জনবল থাকা জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মা প্রথম আলোকে বলেন, ১৩ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়। তবে স্বামী সামাজিকভাবে তাঁকে ও তাঁর অটিস্টিক সন্তানকে স্বীকৃতি দেননি। তিনি বিয়ের পর জানতে পারেন, স্বামীর আগের স্ত্রী-সন্তান আছে। এখন ছেলেকে নিয়ে তাঁকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। ছেলে অটিস্টিক বলে বাবা খুব বিরক্ত হন। একবার মেরে ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। হাত-পা বেঁধে ছেলেকে বাবা মাঝেমধ্যে পেটান। ছেলে তারা বাবাকে দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যায়। তখন ছেলেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।

এই মা এখন তাঁর ছেলেকে একটি আশ্রয়কেন্দ্র বা পুনর্বাসনকেন্দ্রে রাখতে চান। এ জন্য তিনি ফেসবুকে অটিস্টিক সন্তানের অভিভাবকদের একটি গ্রুপে সহায়তা চেয়েছেন। এই মা বলেন, তাঁর নিজের বাবা-মা মারা গেছেন। ভাইবোনেরা তাঁর অটিস্টিক ছেলেকে ‘পাগল’ বলেন। তাই তাঁর অবর্তমানে এই ছেলেকে কেউ যে দেখে রাখবেন, সেই নিশ্চয়তা নেই।

সরকার ২০১৩ সালে স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী অর্থাৎ অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করে। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা হয়। ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধীসহ অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য স্কুল, রিসোর্স সেন্টারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কাজ করছে।

জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদও সরকার অনুসমর্থন করেছে। তবে সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত দেশে কোনো পুনর্বাসনকেন্দ্র নেই, যেখানে স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী শিশু বা প্রাপ্তবয়স্কদের রাখার ব্যবস্থা আছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবন্ধী, বিশেষ করে স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সামাজিক যোগাযোগ, চলাফেরা, ভাববিনিময় ও দৈনন্দিন কাজ করতে পারেন না। ফলে তাঁদের জীবনব্যাপী যত্ন-পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। একই সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিকের মতো তাঁদের পূর্ণ মর্যাদা বা অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা অধিকার রয়েছে। এই অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।

পুনর্বাসনকেন্দ্র আলোর মুখ দেখেনি

নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক-মানসিক-আর্থিকভাবে সহায়তা, উপযোগী শিক্ষা-কারিগরি জ্ঞানের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ট্রাস্টের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাতে পরিবারে বসবাস করতে পারে, সে ধরনের ব্যবস্থা করার কথা বলা আছে। পাশাপাশি বাবা-মা বা অভিভাবক মারা গেলে তাঁদের জীবনব্যাপী পরিচর্যা, অধিকার সুরক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থারও উল্লেখ আছে। তাঁদের জন্য আবাসিক হোস্টেল বা আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন ট্রাস্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইনের বিধিমালায় বলা আছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, আবাসন তৈরি করতে হবে। প্রতিবন্ধকতার ধরন, বয়স-লিঙ্গ অনুযায়ী সুপরিসর কক্ষের ব্যবস্থা, সবার জন্য আলাদা বিছানার ব্যবস্থা, সহজে ব্যবহার করা যায়, এমন বৈদ্যুতিক সুইচ, সেলফ, লকারের ব্যবস্থা, প্রতি দুজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য একজন কেয়ারগিভার নিয়োগসহ নানান বিষয়ের কথা বিধিমালায় বলা আছে। তবে ট্রাস্টের অন্যান্য কার্যক্রম চললেও এমন আবাসন বা পুনর্বাসনকেন্দ্র এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে এ কেন্দ্র যেন এতিমখানার মতো না হয় বা রাখার জন্য রাখা ধরনের না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে বলেছেন।

শাহ আলম জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয় নিশ্চিত করতে দেশের আটটি বিভাগে এমন পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরির জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গত বছর জমা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রী পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকায় একটি কেন্দ্র তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী পরবর্তী কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে পরিচালক (প্রশাসন, অর্থ, অডিট ও কার্যক্রম) হিসেবে যোগ দিয়েছেন মুহম্মদ হিরুজ্জামান। তিনি বলেন, বাবা-মা ফেলে গেছেন বা দরিদ্র প্রতিবন্ধী শিশুদের একটি নিবাসে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এই শিশুরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাবে, তখন তাদের কোথায় রাখা হবে, এটা এখনো বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।

মুহম্মদ হিরুজ্জামান জানান, ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরির চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

দুশ্চিন্তা বাড়ছে অভিভাবকদের

সেরিব্রাল পালসির কারণে তরুণী আফিয়া কবীর আনিলার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে হুইলচেয়ারে। কেউ হুইলচেয়ার টেনে না নিলে নড়তে পারেন না তিনি। কথা বলতেও তাঁর কষ্ট হয়। তবে এসব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে তিনি গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনে (কপ-২৮) বিভিন্ন সেশনে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে কথা বলেন। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাজ্য, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভুটানসহ নানা দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক করেছেন।

আনিলার বাবা আশফাক-উল কবীর। মেয়েকে সময় দেওয়ার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য ২০০৩ সালে তরী ফাউন্ডেশন ও ২০০৪ সালে স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন প্রতিষ্ঠা করেন। উভয় প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আর আনিলার মা মারুফা হোসেন এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আনিলার বাবা-মা অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা-প্রশিক্ষণসহ একটি পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন।

মারুফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স এখন ২৬ বছর। মেয়ের বয়স বাড়ছে। অন্যদিকে আমাদের দুশ্চিন্তাও বাড়ছে। আমরা এখন মেয়ের সব কাজে পাশে থাকছি। আমরা যখন থাকব না, তখন মেয়েকে কে দেখবে? আমার মেয়ের সামনে খাবার থাকলেও মুখে তুলে না দিলে সে খেতে পারে না। গোসল করিয়ে দেওয়াসহ অন্যান্য কাজ তো আছেই।’

মারুফা জানালেন, স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেনে বর্তমানে ৭৫ জন শিশুসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের সেবা পাচ্ছে। এ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাবা বা মা, বিশেষ করে মা মারা গেলে পুরো পরিবারই ভোগান্তির মধ্যে পড়ে। এই চিন্তা থেকে তাঁরা রাজধানীর কাটাসুর এলাকায় চার কাঠা জমিতে তরী ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটি পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরির কাজ করেছেন।

অভিভাবকদের সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেন মারুফা। তিনি বলেন, অটিজমসহ এ ধরনের প্রতিবন্ধী সন্তানদের ছোটবেলা থেকে কোনো স্কুলে দেওয়া, দৈনন্দিন কাজগুলো শেখানোর দিকে অনেক অভিভাবক নজর দেন না। তা ছাড়া প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল গজাচ্ছে। সেগুলোর দিকেও কর্তৃপক্ষের তেমন নজরদারি নেই। ফলে বেশির ভাগ স্কুল শুধু ব্যবসাই করছে। এতে প্রতিবন্ধী সন্তানের কোনো লাভ হচ্ছে না। প্রতিবন্ধী সন্তানদের পুনর্বাসনে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। শুধু পুনর্বাসনকেন্দ্র করলেই হবে না, সেখানে সেবা দেওয়ার জন্য দক্ষ জনবলও তৈরি করতে হবে।

‘রাষ্ট্রই শেষ ভরসা’

নশিন সাইয়ারা একসময় বেসরকারি সুইড বাংলাদেশের খিলগাঁও শাখার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক সোহেল রানা। তিনি জানান, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নশিনকে শিক্ষার্থী হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। নশিনের ভরসার জায়গা ছিলেন তাঁর মা আফরোজা খান। বেশির ভাগ সময় তিনিই নশিনকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন। পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নানা ঝামেলায় নশিনকে একপর্যায়ে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সোহেল বলেন, এ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্কুলে পাঠানো জরুরি। এতে তাঁরা ধারাবাহিকভাবে দৈনন্দিন জীবনের কিছু কাজ শিখতে পারেন। এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। অভিভাবকদের মতো তিনিও চিন্তা করেন, এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কে দেখবে? কেননা অনেক পরিবারেই তাঁরা অবহেলার শিকার হন। সমাজের মানুষ এখনো সচেতন নন। তাই রাষ্ট্রই শেষ ভরসা।

২০২২ সালে ৬ মে টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জি এম মাকসুদ মাসুম প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি লিখেছিলেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী আয়েশা খাতুন ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি দিয়েছিলেন। পরিবারটির নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশও দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছে দিতে একজন কর্মকর্তা তাঁর (মাকসুদ মাসুম) সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তবে পরে আর তাঁদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তাঁর স্ত্রী ২০২১ সালে মারা যান। একমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তানকে তিনিই দেখাশোনা করেছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এই সন্তানকে নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাঁকে। তাই প্রতিবন্ধী সন্তানটি যাতে একটি নিরাপদ আশ্রয় পায়, সে আবেদন তাঁর।

সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে দেশ ছাড়েন এক মা

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একটি পাবলিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন মনিজা রহমান। তাঁর ১৪ বছর বয়সী ছেলে সৃজন হায়দার অটিস্টিক। বাংলাদেশে সাজানো-গোছানো জীবন ছেড়ে শুধু এই অটিস্টিক সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ২০১৪ সালে দেশ ছাড়েন এই মা।

মনিজা বলেন, নিউইয়র্কে অটিস্টিকসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বলে ‘পারসন উইথ স্পেশাল নিডস’ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি। আর অন্যদের বলা হয় ‘টিপিক্যাল’ (সাধারণ)। এখানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এগিয়ে রাখা হয়। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা হিসেবে তিনি অনেক সম্মান পান।

মনিজা জানান, নিউইয়র্কে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা ইনস্যুরেন্স ছাড়াও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আমৃত্যু পায়। এখানে মা-বাবা জীবিত না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ, এখানে অঙ্গরাজ্য দায়বদ্ধ (বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য আলাদা নিয়ম অনুসরণ করে)। মা-বাবার মৃত্যু হলে সন্তান গ্রুপ হোমে আমৃত্যু থাকতে পারে। অঙ্গরাজ্য খরচ বহন করে। মা-বাবা সন্তানকে বাড়ি লিখে দিয়ে গেলে সেখানেও সে থাকতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তাকে দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করার জন্য মানুষ থাকবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ কোটা আছে চাকরিতে। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক চাকরি করতে না পারলেও শারীরিক পরিশ্রমের চাকরি করতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কপ্রবাসী মনিজা রহমানের সঙ্গে তাঁর ছেলে সৃজন হায়দার
ছবি: সংগৃহীত

মনিজা বলেন, তাঁর ছেলে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পিছিয়ে আছে। স্কুল থেকে তাঁকে কীভাবে ঘোড়ার যত্ন করতে হয়, তা শেখাচ্ছে। ছেলের প্রাইভেট স্কুলের বেতন প্রায় দুই লাখ ডলার, যার পুরোটাই দেয় নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন। স্কুলে ছেলে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় থেরাপি পাচ্ছে। ছেলেকে স্কুল বাস বাসা থেকে নিয়ে যায়, আবার দিয়ে যায়। বাসে দেখার জন্য একজন লোক থাকেন। অফিস ফর পিপল অব ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি থেকে ছেলে ঘরে নানা সেবা পাচ্ছে। আজীবন পাবে। ছেলেকে বাসায় দেখাশোনার জন্য সপ্তাহে ৩৭ ঘণ্টার জন্য সহায়তাকারী (হোম এইড) পাওয়া যাচ্ছে। এই সহায়তাকারী ছেলের খাবার তৈরি, রান্না করা, বাজার করা, বিছানা গোছানো, কাপড় ধোয়াসহ সব কাজ করে দিতে বাধ্য। বাসায় সব ধরনের থেরাপিস্ট পাওয়া যায়। মেধা বিকশিত করার জন্য বরাদ্দ পাচ্ছে ছেলে। সে একটা আইপ্যাড পেয়েছে। ট্রেডমিল পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। একজন পেশাদার জিম কোচ বাসায় এসে ছেলেকে ব্যায়াম করান। একজন শিক্ষক পিয়ানো বাজানো শেখান। এর বাইরে সাঁতার, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলা শেখার জন্য ছেলের জন্য অর্থ বরাদ্দ আছে।