এল নতুন দুটি ফুল

ক্যালিকোটম বা কাঁটাযুক্ত ঝাড়ফুল। যশোরের একটি নার্সারি থেকে তোলাছবি: লেখক

পুষ্পপ্রেমীদের হাত ধরে দেশে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের বিদেশি ফুল বা গাছের অভিষেক ঘটছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটির অভিযোজন এতটাই চমৎকার যে আমরা সেগুলোকে নিজেদের হিসেবেই ধরে নিয়েছি। এই তালিকাও অনেক দীর্ঘ। যেমন জবা, গগনশিরীষ, মেঘশিরীষ, কৃষ্ণচূড়া ইত্যাদি। বিদেশি এসব ফুলের রয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। অতি সম্প্রতি দেশে আসা এমন দুটি ফুলের কথাই জানাব আজ।

প্রথমেই ব্রাজিল বাটন ফ্লাওয়ার বা ব্যাচেলর বোতাম ফুল সম্পর্কে জানা যাক। এটির ইংরেজি নাম থেকে বোঝা গেল, ফুলটির আদি আবাস দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল এবং সংলগ্ন অঞ্চলগুলো। চার বছর আগে ফুলটি প্রথম দেখি বান্দরবানের সাইরু হিল রিসোর্টে। প্রথম দেখায় কিছুটা দ্বিধায় পড়েছিলাম। ফুলটি আমাদের বন-পাহাড়ের না তো? তাহলে এত দিন চোখে পড়েনি কেন? পাহাড়ের অন্যান্য লতাগুল্মের সঙ্গে দিব্যি দ্যুতি ছড়াচ্ছিল ফুলটি। বুঝতে পারি, কাজটি রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী স্থপতি মোস্তফা আমিন বাবুলের কীর্তি! তিনি ফুলটিকে স্থানীয়ভাবে অভিযোজনের চেষ্টা করছেন হয়তো। গত বছরের ডিসেম্বরে দেখেছি যথারীতি অনেক ফুল ফুটে আছে সেখানে। পরে অবশ্য অনেক স্থানেই ফুলটি দেখেছি। প্রায় বর্ষব্যাপ্ত প্রস্ফুটন প্রাচুর্য এবং চটকদার নীলচে বেগুনি রঙের জন্য এই ফুল এরই মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ কারণে কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, ফ্রেঞ্চ গায়ানা, গায়ানা, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, ফিলিপাইন ও ত্রিনিদাদসহ পৃথিবীর অন্যান্য উষ্ণাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। গাছটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে জন্মাতে পারে।

ব্রাজিল বাটন ফ্লাওয়ার খাড়া, বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ প্রজাতি, প্রায় ১ থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। নলাকার কাণ্ড ওপরের অংশে ছড়িয়ে পড়ে। খাটো ডানাযুক্ত পাতাগুলো সুগন্ধি, ২ থেকে ৮ সেন্টিমিটার লম্বা, সরল ও কিনারা দাঁতের মতো অসমান। ফুল গোলাকার, প্রায় সাড়ে ৩ সেন্টিমিটার চওড়া, দুই স্তরের অসংখ্য ঘনবদ্ধ ফুলসদৃশ পাপড়িতে দৃষ্টিনন্দন। প্রতিটি একক ফুল ৩০ থেকে ৬০টি টিউবুলোজ ফুলের মাধ্যমে গঠিত। মাঝখানে ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি অর্ধগোলাকার বৃত্তের মতো রয়েছে; যা ৩০ থেকে ৫০টি মঞ্জরি ঢাকনায় বেষ্টিত। ফল ফ্যাকাশে বাদামি বর্ণের, রৈখিক, ডোরাকাটা, ১ থেকে দেড় মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা ফ্যাকাশে হলুদ রঙের। বাতাসের মাধ্যমে বীজ ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে কোথাও কোথাও আগ্রাসী প্রজাতি হিসেবেও আতঙ্কের কারণ হয়েছে।

বান্দরবানের সাইরু হিল রিসোর্টে ব্রাজিল বাটন ফ্লাওয়ার
ছবি: লেখক

ক্যালিকোটম বা কাঁটাযুক্ত ঝাড়ফুল

যশোর শহরের একটি নার্সারিতে এই ফুল প্রথম দেখি। নাম জানতে চাইলে এমন এক অদ্ভুত নাম বললেন তাঁরা, যা আর কোনোভাবেই স্মরণে আনতে পারিনি। অবশ্য কোনো বাংলা নামও থাকার কথা নয়। কারণ, ফুলটি একেবারেই নতুন। উদ্ভিদবিষয়ক পর্যবেক্ষণ শেষে নিশ্চিত হই, এটি ক্যালিকোটমের একটি রকমফের। অবশ্য ইংরেজি নামের অর্থ দাঁড়ায় কণ্টকিত ঝাড়-ফুল। ঝুলন্ত ডালপালায় সোনালি রঙের অজস্র ফুলের সৌন্দর্য চোখ ধাঁধানো। ফুলের প্রাচুর্যে পাতাগুলো প্রায় অদৃশ্য। মূলত প্রস্ফুটন প্রাচুর্যের কারণেই ফুলটি সর্বত্র আদৃত।

ক্যালিকোটম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ঝোপাল উদ্ভিদ। ক্যালিকোটম গ্রিক শব্দ কালক্স, ক্যালিক্স এবং টমোস থেকে উদ্ভূত। মূলত এই ফুল ফোটার পর ক্যালিক্স বা বৃতি বৃত্তের ভেতর ভেঙে যায়, যা দেখতে অনেকটা কেটে ফেলা অংশের মতো দেখায় বলেই এমন নামকরণ।

কাঁটাযুক্ত ঝোপাল এই গাছ ১ থেকে ২ মিটার উঁচু হতে পারে। তিনটি উপপত্রসহ পাতাগুলো শাখার ওপর ক্লাস্টারে ঢোকানো। ডালে পাতার মাঝখানে ফুলগুলো ঘনবদ্ধভাবে থাকে। ফুল ফোটার মৌসুম দীর্ঘ।

প্রাচীনকালে তিলের তেলের স্বাদ নিতে এ ফুলের ব্যবহার করা হতো। দশম শতাব্দীর চিকিৎসক আল-তামিমি প্রক্রিয়াটির বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘ফিলিস্তিনে সাধারণত কাঁটাযুক্ত হলুদ রঙের ঝাড়-ফুল সংগ্রহ করার প্রচলন ছিল। প্রখর রোদে ঘন বোনা চটের ওপর ফুলগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হতো।’ এই প্রক্রিয়ায় আর্দ্রতা বাষ্পীভূত না হওয়া পর্যন্ত এবং তিলবীজ ফুলের মিষ্টি গন্ধ শোষণ করা অবধি অপেক্ষা করা হতো। এক বা দুই দিন পর ফ্লোরেট বা পুষ্পিকা এবং তিলের বীজ আলাদা করা হতো। বর্তমানে ফ্লোরেট বা পুষ্পিকাগুলো আরবীয়রা মাখনের সঙ্গে ব্যবহার করেন।

মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক