‘কেউ যেন স্বজন হারা না হয়’

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোনালিসা জেরিন। মৃত্যুর এক মাস আগে স্বামী ও মেয়ের সঙ্গে তিনিছবি: সংগৃহীত

স্ত্রী মোনালিসা জেরিন ও মেয়ে রুকাইয়া ইসলামকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল রাকিবুল ইসলামের। তবে সব তছনছ করে দিয়েছে ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ৬ জুন মারা গেছেন উদ্যোক্তা মোনালিসা।

আড়াই বছর বয়সী মেয়ে রুকাইয়াকে দেখভাল করার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন রাকিবুল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত দরিদ্রদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে স্ত্রীর নামে বরগুনায় চালু করেছেন ‘জেরিন স্মৃতি কেয়ার’ নামের একটি ফাউন্ডেশন।

রাকিবুল টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আর আমার স্ত্রী একসঙ্গেই বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হই ২ জুন। স্ত্রীর ডেঙ্গু পজিটিভ ছিল, আর আমার জ্বর ছিল। স্যালাইন, প্যারাসিটামল ছাড়া ৬ জুন পর্যন্ত আর কোনো সেবা বা পরামর্শ পাইনি। এর মধ্যে এক দিন মেডিকেল অফিসারের দেখা পেয়েছিলাম।’

মোনালিসা মারা যাওয়ার পর রাকিবুল নিজ উদ্যোগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে গাফিলতির জন্য মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন শুরু করেন। তখন কিছুদিন প্রশাসন ডেঙ্গু প্রতিরোধে তৎপর ছিল। তারপর আগের মতোই সব ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। রাকিবুল বললেন, বরগুনাকে ডেঙ্গুর জন্য ‘হটস্পট’ও ঘোষণা করা হয়েছে। পৌর শহরে কিছুদিন মশা মারার জন্য স্প্রে করা হলেও এখন তা–ও আর দেখা যায় না।

একজন রাকিবুলের উদ্যোগে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি সরকারের বিভিন্ন পরিসংখ্যানই তা বলে দিচ্ছে, বরং দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক হচ্ছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা বারবার সরকারকে সতর্ক করছেন।

গত ২২ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক চিকিৎসক মো. আবু জাফর বলেছিলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর ডেঙ্গুতে ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৪৯ জন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৬০ হাজার ৭৯১।

‘যাদের স্বজন মরে, শুধু তারাই এর জ্বালা বোঝে’

নারায়ণগঞ্জের কাশীপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী মো. শাহ আলম মাদবর (৪৫) ফেসবুকে ‘আলোকিত কাশীপুর’ নামে একটি পেজের অ্যাডমিন প্যানেলের সদস্য। এই পেজে ডেঙ্গুতে মারা গেছে—এমন ব্যক্তিদের নাম, পরিচয় ও ছবি দেওয়া হচ্ছে। শাহ আলম মাদবর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৯ জন মারা গেছেন বলে পেজে তথ্য দিয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানান।

 শাহ আলম মাদবরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করা হয়। মেসেঞ্জারে একজনের ফোন নম্বরের সঙ্গে শাহ আলম পরিচয় লিখে দিয়েছিলেন, ‘মানিকের মায়ের নম্বর’।

রতন দেওভোগ হাজী উজির আলী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ফোন করে ডেঙ্গুতে মানিকের বিষয়ে জানতে চাইলে লাকি আক্তার মোবাইলে বললেন, ‘আমার মানিক মরে নাই, রতন মরছে। ওরা যমজ আছিল।’

রতন দেওভোগ হাজী উজির আলী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। মানিকও একই ক্লাসে পড়ে। তাদের আরেক ভাইয়ের নাম রমজান, বয়স ৫ বছর।

লাকি আক্তার জানান, তাঁর স্বামী ১০ মাস আগে সৌদি আরবে কাজ করতে গেছেন। দেশে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারেন না। রতনকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছেন। অবস্থা খারাপ হলে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। নানা পরীক্ষা ও ওষুধপত্র—সব মিলিয়ে ৭০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। জানালেন, মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে খরচ সামাল দিয়েছেন।

জাকারিয়া হোসেন

এ ইউনিয়নেরই কাশীপুর হাটখোলা উচ্চবিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত মো. জাকারিয়া হোসেন। জাকারিয়ার বাবা রিয়াজ হোসেন জানালেন, দুই ছেলের মধ্যে জাকারিয়া বড় ছিল। জাকারিয়ার ছোট ভাইয়ের বয়স ৩ বছর।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রিয়াজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে সরকার আছেনি? রাজনীতিবিদেরাও খালি ক্ষমতায় যাওনের চেষ্টায় আছে। হাসপাতালে সিট নাই, চিকিৎসা নাই। যার সন্তান, বাবা, মা, ভাই মরে শুধু তারাই এর জ্বালা বোঝে।’ চিকিৎসার খরচ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসায় কত খরচ হইছে, তা বইল্যা আর কী হইব? আমার ছেলেই তো আর দুনিয়ায় নাই। ছেলেরে বাঁচানোর জন্য যতটুকু চেষ্টা করন যায়, তাই করছি।’

ফরাস হোসেন

কাশীপুর ইউনিয়নের ফরাস হোসেন (২৪) নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ফরাসের মামা শহীদুর রহমান জানান, ফরাসের বাবা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। ফরাস ও তাঁর বড় ভাইয়ের আয়ে সংসার চলত। ছোট ভাইয়ের বয়স ১২ বছর। 

রডমিস্ত্রি শহীদুর জানালেন, ভাগনে ফরাস ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার আগে চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে খরচ হয়েছে ১১ হাজার টাকা। জ্বর আসার পর ফরাসের চিকিৎসায় পরিবার খুব কম সময় পেয়েছিল। 

কাশীপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী মো. শাহ আলম মাদবর প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় প্রায় প্রতি বাড়িতেই ডেঙ্গু রোগীর দেখা মিলছে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার সংখ্যা বাড়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভও বাড়ছে। তবে কয়েক দিন হলো ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে মশা মারার স্প্রে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরে দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত ও অপর্যাপ্ত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের কারণে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে।

‘কেউ যেন স্বজনহারা না হয়’

৮ অক্টোবর রাজধানীর শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সালমা আক্তার। মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে স্টাফ নার্স সালমা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সালমা ও মো. আলী জিন্নাহ দম্পতি তাঁদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন। তবে ডেঙ্গুতে সব শেষ হয়ে গেছে।

২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘সমীরের সুখের সংসার তছনছ, ডেঙ্গুতে স্ত্রী-মেয়ের মৃত্যু’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সমীর মণ্ডল ও জয়ন্তী বিশ্বাস। ৯ বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়; নাম রাখেন প্রতিভা। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক দিনের ব্যবধানে জয়ন্তী ও প্রতিভার মৃত্যু হয়। এই দম্পতির আরেক মেয়ের বয়স তখন ছিল মাত্র ছয় মাস। সমীর পরিবার নিয়ে রাজধানীর মিরপুরে থাকতেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত সমীর জানিয়েছিলেন, ১৪ সেপ্টেম্বর জয়ন্তী (৩৪) এবং ১৭ সেপ্টেম্বর প্রতিভার (৩) ডেঙ্গু ধরা পড়ে। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২১ সেপ্টেম্বর জয়ন্তীকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। রাজবাড়ীর বাঘুটিয়া গ্রামে তাঁর শেষকৃত্য হয়। সমীর ঢাকায় ফিরতে ফিরতে পরের দিন মেয়ে মারা যায়।

আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান তরুণ চিকিৎসক তাহসিন আজমীর। তিনি চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) ইয়ংওয়ান লিমিটেডে চিকিৎসা কর্মকর্তা ছিলেন। স্বামী তৌহিদুল ইসলাম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। এই দম্পতির মেয়ে সুহাইরার বয়স মাত্র দেড় বছর।

গত ১৮ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু বিষয়ে ১১ সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটির প্রধান কাজ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে সাড়া দান কৌশল তৈরি করা। ডেঙ্গু বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি, কৌশলপত্র তৈরি ও গাইডলাইন হালনাগাদ করাও এই কমিটির কাজ। এই কারিগরি কমিটি ডেঙ্গু রোগীদের সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে দিকনির্দেশনা দেবে।

মোনালিসার স্বামী রাকিবুল ইসলাম বললেন, ‘আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই, ডেঙ্গুতে আমার মতো কেউ যেন স্বজনহারা না হয়, আমার মেয়ের মতো কেউ যেন এত অল্প বয়সে মা–হারা না হয়।’