ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ হলেও এ ধরনের ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটে। যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। এর মধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১১ ছেলেশিশু ধর্ষিত হয়েছে। ছেলেশিশুদের ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ করা হয় না বা এড়িয়ে যাওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার নজিরও তুলনামূলকভাবে কম। এ ছাড়া ছেলেশিশু ধর্ষণের বিষয়টি বিদ্যমান আইনগুলোতে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি।
বাংলাদেশে কোনো নারী বা মেয়েশিশু ধর্ষিত হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর অধীন মামলা করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’ ‘ধর্ষণ’ বলতে কী বোঝায়, সেটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায়। এখানে ধর্ষণ বলতে শুধু ‘নারী ধর্ষণ’ বোঝানো হয়েছে।
অপর দিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ‘শিশু’ বলতে অনধিক ১৬ বছর বয়সী যেকোনো ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে এবং মেয়েশিশু বা ছেলেশিশু—কোনো নির্দিষ্ট করা হয়নি। অর্থাৎ এটা উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে একধরনের অসচেতনতা থাকায় ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হলে অনেক ক্ষেত্রেই দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী মামলা করা হয়। লক্ষণীয় হলো, এ ধারায় ছেলেশিশু ধর্ষণের বিষয়ে কোনো কিছু বলা নেই। ধারাটি মূলত ‘প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে’ স্বেচ্ছায় সংগম ও সমকামিতার অপরাধ বিষয়ে বলা হয়েছে।
দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারার স্পষ্ট কিছু বলা না থাকলেও ছেলেশিশুকে বলাৎকারের অপরাধ ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে বলে মত দিয়েছেন উচ্চ আদালত। একটি মামলায় [আব্দুস সামাদ (মো.) বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য, ১৯ বিএলসি (২০১৪) ১৭১] আদালত বলেন, যেহেতু ১৬ বছরের কম বয়সী একটি শিশু যৌনমিলন বা সমকামিতায় সম্মতি জানাতে পারে না, তাই কোনো পুরুষ কর্তৃক সম্মতিসহকারে কোনো ছেলেশিশুর সঙ্গে সমকামিতাও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারার অধীন শাস্তিযোগ্য ধর্ষণের আওতাভুক্ত হবে। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অধীন ফৌজদারি কার্যক্রম শুরু করতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে।
ছেলেশিশুর মতোই ১৬ বছরের অধিক বা প্রাপ্তবয়স্ক কোনো পুরুষও ধর্ষণের শিকার হতে পারে। ২০২২ সালের ১৮ মার্চ রংপুরের পীরগাছা থানার এসআই স্বপন কুমার রায়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেছিলেন ৪৮ বয়সী এক ভ্যানচালক। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে তাহলে কী হবে? কারণ, দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের যে সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেখানে শুধু একজন নারীর সঙ্গে সংঘটিত পুরুষের অপরাধকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু পুরুষকে ধর্ষণের বিষয় কোনো কিছু বলা হয়নি।
ধর্ষণের প্রচলিত সংজ্ঞাটি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। কিন্তু ধর্ষণের বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অপর পুরুষ বা নারীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলে তিনি ধর্ষণের মামলা করতে পারেন না। সংজ্ঞায় বৈবাহিক অবস্থায় ধর্ষণ বা ইদ্দতকালীন যৌনমিলনের বিষয়ে কিছু বলা নেই। এ ছাড়া হিজড়া, রূপান্তরিত নারী বা পুরুষ ধর্ষণের বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি।
নারী ও মেয়েশিশুর মতো ছেলেশিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষও যে ধর্ষণের শিকার হতে পারেন, সেটার আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ। কিন্তু আমাদের এখানে এখনো এ ধরনের কোনো স্বীকৃতি নেই। এর একটি কারণ হলো, যে দণ্ডবিধি অনুসারে ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, সেটি ১৬৩ বছর আগের। তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। একজন পুরুষও যে ধর্ষণের শিকার হতে পারে, তখনকার প্রেক্ষাপটে তা হয়তো চিন্তাভাবনার বাইরে ছিল। কিন্তু এখন অনেক কিছুই নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
সোলায়মান তুষার আইনজীবী