বৃহত্তর আত্মপরিচয়ের প্রতি বাংলাদেশের দায়বদ্ধতা আছে

দীপেশ চক্রবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস প্রফেসর। তাঁর চর্চার ক্ষেত্র ইতিহাস। নিম্নবর্গের অধ্যয়ন, উত্তর–উপনিবেশ তত্ত্ব এবং জলবায়ু ও পরিবেশ তাঁর গবেষণার বিষয়। তাঁর আরও আগ্রহ ও অনুসন্ধানের বিষয় পূর্ববঙ্গ, বাংলাদেশ ও তৃতীয় বাংলা। রিথিঙ্কিং ওয়ার্কিং ক্লাস হিস্টরি, প্রভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ, হ্যাবিটেশনস অব মডার্নিটি তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ তাঁর এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

দীপেশ চক্রবর্তী
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

প্রথমেই আপনার জীবনের ব্যক্তিগত পটভূমিটা সামান্য জেনে নিই।

দীপেশ চক্রবর্তী: আমার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর। কলকাতার মেডিকেল কলেজে। আমার বাবা-মা দুজনই পূর্ববঙ্গের। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী এলাকার। তবে বাবাদের পরিবার হচ্ছে সে রকম বাঙাল, যারা আগে থেকেই কলকাতায় এসে চাকরিবাকরি করে, ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যায়। তাঁর গ্রামের নাম ছিল ফুরশাইল। দুই পরিবারই বজ্রযোগিনী অঞ্চলের ব্রাহ্মণ এটাই জানি। মায়েরাও তা–ই। বাবারা বংশসূত্রে পণ্ডিত, পুরোহিত, মাস্টার ইত্যাদি। মায়েদের পরিবার যদিও ব্রাহ্মণ ছিল, আমার নানা ছিলেন পাটের আড়তদার। সে সূত্রে মারোয়াড়ি আর সাহেব পাট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যার পাশেই মায়ের বেড়ে ওঠা। ১৯৪৬ সালে তাঁরা কলকাতায় চলে এলেন। আমার মা তখন তাঁর মামাবাড়ি ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে বিএ পাস করেছেন। সেখানে তাঁর মামা অবনীমোহন চক্রবর্তী ছিলেন রাজেন্দ্র কলেজের নামী প্রিন্সিপাল। কলকাতায় আসার পর মা বাংলায় এমএ করেন। এখানে তিনি ছিলেন সলিল চৌধুরীর সহপাঠী। মা ছিলেন বিএ ক্লাসের একমাত্র মেয়ে। তাঁর কাছ থেকে অনেক মজার গল্প শুনে আমি বড় হয়েছি।

প্রশ্ন :

দেশত্যাগী বাঙাল দম্পতির সন্তান হিসেবে আপনার বড় হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

দীপেশ: ছেলেবেলায় আমাদের বাঙাল থেকে ঘটি হওয়ার প্রচেষ্টা ছিল। যেমন আমরা ‘ড়’ আর ‘র’–এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারতাম না। চন্দ্রবিন্দুর কারণে অনুনাসিক ধ্বনির উচ্চারণ আমাদের আসত না। কবিতা ‘আ–বৃত্তি’ করে নাকি ‘আব্‌বৃত্তি’ করে, তা ঠিকমতো বুঝতাম না। ‘আমার বনে বনে ধরল মুকুল,/ বহে মনে মনে দক্ষিণহাওয়া’ হবে, নাকি ‘আমার বোনে বোনে ধরল মুকুল, বহে মোনে মোনে দক্ষিণহাওয়া’ উচ্চারণ করতে হবে, এগুলো শিখতে হয়েছে। আমাদের বাঙাল বাড়িতে যাঁরা এগুলো শেখাতেন, তাঁরা একটু–আধটু অত্যাচার করতেন। আমার এক জ্যাঠামশাই বিশ্বভারতীর রেজিস্ট্রার ছিলেন। তিনি ছিলেন গণিতের শিক্ষক। সেখানে গিয়ে আমি এভাবে গাইলে চাচাতো বোনেরা বলত, উচ্চারণ ভুল হচ্ছে। যিনি আমাদের গান শেখাতেন, তিনিও তো বাঙাল। তাকেও এ বিষয়গুলো শিখতে হয়েছে। বাঙালদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথও ঠাট্টা করতেন। ছিন্নপত্র–এ তিনি লিখেছেন, ‘ঘোড়ার’ কথাকে বাঙালরা বলে ‘গোরা’র কথা। বাঙাল অ-সভ্য, তাকে সভ্য করতে হবে। ঠাট্টা হলেও ছোটবেলায় এটা আমাদের শুনতে হয়েছে।

প্রশ্ন :

ছোটবেলায় এই একটা অতিরিক্ত চাপ আপনাদের ছিল?

দীপেশ: ছোটবেলায় যেটা চাপের মনে হতো, বড় হয়ে সেটা তো অর্জন মনে হয়েছে। ধীরে ধীরে সে কথা বুঝলাম শম্ভু মিত্রের আবৃত্তি ও উচ্চারণ শুনে। তিনি পেয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছ থেকে। শিশির ভাদুড়ী নাটকের জগতে একটা বদল এনে দিয়েছিলেন। তিনি সেটা পেরেছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক হওয়ার কারণে। পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলতে হবে, উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বানানটা স্পষ্ট করতে হবে। বর্ণবিপর্যয় বা অপিনিহিতি তো আমাদের বৈশিষ্ট্য। সত্যি কথা বলতে কি, কলকাতার ভাষাটাকে ভালোবাসতে শিখলাম। এ ভাষার ওপর দেড় শ বছর ধরে কয়েক প্রজন্ম কাজ করে গেছে। তখন একটা বোধ আমার হয়েছে যে আমরা বাঙাল, তাই বলে কি আমরা ভালো করে বাংলা বলতে পারব না? ভালো বলতে কলকাতার মতো করে কথা বলা।

প্রশ্ন :

আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলেন। নানা পথে এঁকেবেঁকে চলে এলেন ইতিহাসে। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হলেন কী করে?

দীপেশ: আমি ঐতিহাসিক বরুণ দের শিক্ষার্থী ছিলাম। ম্যানেজমেন্ট পড়তে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। তাঁর প্রশিক্ষণে আগে থেকেই আমি শ্রমিক শ্রেণি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলাম। নিম্নবর্গের ইতিহাস প্রকল্পে আমাকে যুক্ত করলেন রণজিৎ গুহ। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় পিএইচডি করতে গেছি। রণজিৎদার ক্যানবেরা আসার কথা। আমার সুপারভাইজার অ্যান্টনি লো তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পরে আমি নিজেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। রণজিৎদা বললেন আগে তাঁর কাছে যেতে। আমি তাঁর ওখানে গিয়ে তিন দিন ছিলাম। তিনি তখন এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পিজেন্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া লিখছিলেন। নিম্নবর্গ নিয়ে তখন তাঁর মাথায় চিন্তা কাজ করছে। তাঁর সঙ্গে তখন আছেন ডেভিড আরনল্ড, ডেভিড হার্ডিম্যান, জ্ঞান পাণ্ডে আর শাহিদ আমিন—এই চারজন। তিনি আমাকে তাঁর লেখা থেকে একটি অধ্যায় পড়ে শোনালেন। তাঁর ইংরেজির দখল ও চিন্তার ভাস্কর্য দেখে আমার চোখে ঠুলি পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তিন দিন ধরে তাঁর সঙ্গে নানা আলোচনা হলো।

বাহ্য প্রকৃতি নিয়ে আমার দারুণ আগ্রহ ছিল। বস্তুর ইতিহাস আমাকে আকর্ষণ করত। নদী কেন বেঁকে যায়, পাহাড় কীভাবে হয়—এসব জানতে ইচ্ছে করত। আবার আইডিয়া বা ইতিহাসের সত্যও ভালো লাগত। রণজিৎদার মধ্যে আইডিয়ার ইতিহাসে একটা গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি বলতেন, কার্ল মার্ক্সকে বুঝতে হলে মার্ক্স যাঁদের যাঁদের পড়তেন, তাঁদের পড়তে হবে। আবার তাঁদের বুঝতে চাইলে তাঁরা যাঁদের পড়তেন, তাঁদের পড়তে হবে৷ অর্থাৎ একটা টেক্সট বুঝতে হলে তার মধ্যে জড়ো হয়ে থাকা অন্য টেক্সটগুলোও বুঝতে হবে। তিনিই তখন আমাকে কাঠামোবাদে আগ্রহী করে তোলেন।

প্রশ্ন :

তাঁর সংস্পর্শে যে উত্তেজনা সঞ্চারিত হলো, সেটাই আপনাকে নিম্নবর্গের ইতিহাসে নিয়ে এল?

দীপেশ: দেখুন, উপমহাদেশের সমাজ তো পেটানোর সমাজ। যে ওপরে থাকে সে নিচের লোকজনকে পেটায়। স্বামী বউকে পেটায়, মনিব ভৃত্যকে পেটায়, জমিদার প্রজাকে পেটায়। নিচু পর্যায়ে এসব সহিংসতা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়াকে বোঝা যায় না। এসব রণজিৎদার আলোচনায় ছিল। না পড়লেও অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারতাম এসব সত্যি। আমি বুঝতে পারলাম, রণজিৎদা কাঠামোবাদ প্রয়োগ এই সহিংসতার ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করলেন। আমি জানতে চাইলাম, কাঠামোবাদ তিনি কোথায় পেয়েছেন। তিনি জানান, সাসেক্সে থাকাকালে জন বার্জারের ছবি আঁকাবিষয়ক বই থেকে তিনি কাঠামোবাদ শিখেছেন। কারণ, এক সময়ে রণজিৎদা নিজে ছবি আঁকায় আগ্রহী হন। তাঁর উৎসাহে আমি বই পড়তে আর আলোচনা করতে শুরু করি।

নকশাল আন্দোলন শুরু হলো। ১৯৭০ সালে রণজিৎদা দিল্লি এলেন। গান্ধীকে নিয়ে বই লিখবেন। দিল্লির এলিট নকশাল—যাদের মধ্যে শাহিদ আমিন ও জ্ঞান পাণ্ডে ছিল—তাদের রণজিৎদা সাহায্য করেন। মাও সে–তুং বলেছিলেন, বিপ্লবের কোনো বৈধতার দরকার হয় না। রণজিৎদার মধ্যে এই বোধটি ছিল। আমাদেরও ছিল। আমরা ভাবতাম বিদ্রোহের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য ও বৈধতা আছে। এ কারণে আবুল মনসুর আহমদের লেখা আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর আমার প্রথম পাঠেই এত ভালো লাগে। বইটার শুরুই তো এক বিদ্রোহে, তাঁর জমিদারমশাইকে ‘তুই’ সম্বোধন। এ হচ্ছে আত্মসম্মানের ইতিহাস। আত্মসম্মানের ইতিহাসের প্রতি আমার শুরু থেকেই শ্রদ্ধা ছিল। এটি আমি শিখেছি গরিব বাঙালি ব্রাহ্মণের বাড়ি থেকে। পৃথিবীতে আমি তত দূরই যাব, আমার পরিশ্রম ও ক্ষমতা যত দূর আমাকে নিয়ে যায়। কাউকে তৈলমর্দন করে নয়।

পয়সা হলেই যে ক্ষমতা চায়, তার সঙ্গে আমার মনের লড়াই। এ হলো চিন্তার সঙ্গে ক্ষমতার সংঘাত। রণজিৎদার মধ্যে জ্ঞান অর্জনের এ চেতনাটা ছিল। আজকাল ডাকলেই আমরা ছুটে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কনফারেন্সে চলে যাই। রণজিৎদাদের সময় এসবের সুযোগ ছিল না। এই লোভও ছিল না। রণজিৎদাকে একবার ফ্রেডরিখ জেমিসন টিকিটসহ আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন, তিনি যাননি।

প্রশ্ন :

প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করি, বাঙালি উচ্চবর্গের বিপরীতে আপনারা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চায় নিমগ্ন হলেন। সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি, প্রৌঢ়ত্বে এসে আপনারা রামমোহন বা বিদ্যাসাগর থেকে গান্ধী বা নেহরু—এঁদের নিয়ে লিখতে শুরু করেছেন। আপনাদের এই ফিরে আসার পেছনে আলাদা কোনো অবলোকন আছে, নাকি এটা বেশি বয়সে তীর্থে ফেরা?

দীপেশ: আয়ু যত নিঃশেষ হয়ে যায়, ততই মনে হয় এমন একটা চিন্তা করা দরকার, যা অনেক সমগ্রতায় পৃথিবীকে ধরতে পারে। আমি ভাবতাম, অভিজ্ঞতা দিয়ে (এম্পিরিক্যালি) জগৎকে জানা যাবে না, আইডিয়ার কাছে আসতে হবে। সে আইডিয়া ভুল হতে পারে, কিন্তু সে ভুল সত্ত্বেও এই সান্ত্বনা নিয়ে মরতে চাই যে পৃথিবী বা জীবনকে আমি কিছুটা অন্তত বুঝতে পেরেছি। এর ভেতর দিয়েই একটা সৌন্দর্য পাওয়া যায়। আর যুক্তির কাছে নিজেকে নিবেদন করাও একটা সাধনার বিষয়। তার মধ্যে অহং থাকতে পারে না। এই যে সত্যের কাছে নিঃসংকোচ আত্মসমর্পণ, এটা ছাড়া তো মানুষে মানুষে মৈত্রী হবে না। না হলে ভাবের মিলন কীভাবে হবে। তবে এটাও কাউকে ধরিয়ে দিতে হবে। কারণ, ভাবের গতি কোন দিকে যাবে, তার তো নিশ্চয়তা নেই।

প্রশ্ন :

ইতিহাস তো বিস্তৃত আর বিচিত্র একটি বিষয়। বহু রকমভাবে এখন ইতিহাস লেখা হচ্ছে। আপনারাও একধরনের ইতিহাস লিখেছেন। অখণ্ড ইতিহাসের ধারণা বলে কি তাহলে কিছুই রইল না?

দীপেশ: বিশ্বায়নের—বা কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যাকে বলতেন গ্লোবায়ন—তার ফলে সব ইতিহাস এমনভাবে এক হয়ে গেছে যে মনে হয় ইতিহাসের সমস্যা বোধ হয় সর্বত্রই এক। আসলে কিন্তু তা নয়। আমেরিকায় দেখি সব ইতিহাস মার্কিন ইতিহাস হয়ে গেছে। দলিতরাও এখন কালোদের মতো। যেন যুক্তরাষ্ট্রের কালো আর এ অঞ্চলের দলিতদের ইতিহাস অভিন্ন। আমি সম্প্রতি লিখেছি, আমেরিকা হাঁচি দিলে পৃথিবীর সর্দি লাগে। এ নিয়ে আমার বন্ধুরা আপত্তি করেছেন। আমরা বলছি, সব ইতিহাস এক হয়ে গেছে। আসলে যেটা হয়েছে, সেটা হলো ইতিহাসের মার্কিনীকরণ।

প্রশ্ন :

পৃথিবীর ইতিহাস থেকে যদি আমরা আমাদের এ অঞ্চলের দিকে চোখ রাখি, তাহলে কি বলতে পারব যে ভারতবর্ষের এমন একটা ইতিহাস রচনা করা সম্ভব, যেখানে বাংলাদেশ–ভারত–পাকিস্তান, হিন্দু–মুসলমান বা পূর্ববঙ্গ–পশ্চিমবঙ্গ সবাই একই সমতল থেকে অংশ নিতে পারে?

দীপেশ: পার্থ চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ভারতকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন দেখায়। ‘জনগণমন’ গানটিও পুরো ভারতকে এক ছাতার তলায় আনতে পারে না। তামিলনাড়ু থেকে যে ভারত দেখি, উত্তরবঙ্গ থেকে তো সে ভারত দেখা যায় না। আমার মনে হয়, এ রকম ইতিহাসই তো হওয়া সংগত। ইউরোপের ইতিহাস যদি দেখি, একটা কাতালান ইতিহাস যেমন হবে, পর্তুগিজ ইতিহাসও তো তেমন হবে। অথচ অনেক সময় একটা আরেকটাকে ভেদ করেছে।

প্রশ্ন :

ইতিহাস যদি সে রকমই হয়, তাহলে তো হিন্দু বা মুসলমান উগ্রবাদীদেরও তার ওপর একটা দাবি থেকে যাবে, তাই নাকি?

দীপেশ: হ্যাঁ, থাকবে। তাঁদের নিজস্ব দেখার দৃষ্টি আছে। তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে, কিন্তু ইতিহাসচিন্তাকে তো একটা ‘নিরাপদ পরিসর’–এ পর্যবসিত করা যায় না। মানুষে মানুষে ভিন্নমত আর মতের সংঘর্ষ থাকবেই। মানুষের মধ্যে একটা দ্বিত্ব আছে। একদিকে মানুষ মিলতে জানে, সহযোগিতা করতে জানে। তা না হলে তো জাতিরাষ্ট্র হতো না। আবার মানুষ যদি এক হয়, তাহলেও সেটা খুব ক্ষণিকের জন্য। মানুষের পরম ঐক্য খুব ভঙ্গুর জিনিস। মানুষ অতীতেও ছোট ছোট গোত্রে থাকত, মারপিট হতো। মানুষের মধ্যে ঝগড়া হতে পারে, এই আশঙ্কা মাথায় রেখেই সমাজটা তৈরি হয়। আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি আছে, আমরা যাকে বলি ট্রাইবাল ইন্সটিঙ্কট। এই পাড়ার সঙ্গে অন্য পাড়ার ঝগড়া। আমাদের দাবি আছে। ওদেরও আছে। পৃথিবীতে এমন লোক থাকবে, যে আমার মতের সম্পূর্ণ বিপরীত হবে। আমরা যদি এই জায়গাটা না রাখি, যদি ক্ষমতা দিয়ে তাদের সম্পূর্ণ অপসারণ করি—সেটা তাদের মতোই অসহনশীল হবে। তার সঙ্গে আমার তর্ক হবে, সংঘাত হবে, প্রয়োজনে মারপিট হবে। সে যদি যুদ্ধ করে, তাহলে লড়তেও হবে। সে যদি খুন করতে চায়, লড়াই তো আমাকে করতেই হবে। কিন্তু তার থাকারই কোনো অধিকার নেই, সেটি তো হয় না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এ অঞ্চলে আমরা এখন ধর্মীয় উগ্রতার সময় পার করছি। উগ্রবাদীরা প্রত্যেকেই ভিন্ন সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বাসনায় ইতিহাসের সংকীর্ণ দাবি হাজির করছে। ইতিহাসে তো পরস্পরবিরোধী ঘটনার অন্ত নেই। ধর্মগুলোতে মমতা আর নিষ্ঠুরতার নজির জড়াজড়ি করে আছে। ইতিহাসের এই নৃশংস ব্যবহারের তাহলে কোনো ইতি নেই?

দীপেশ চক্রবর্তী: এটা সত্যি যে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। ইতিহাসের ব্যবহারও সেখানে হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে শ্রেণিকক্ষে আমি কী করি? আমি যখন বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের কাজিয়ার টেক্সট পড়াই, আমি সেটা একটা পটভূমি দিয়ে ছাত্রদের বোঝাই। ওদের ব্যাখ্যা করে বলি, ওই সময় দাঁড়িয়ে কেন তারা সে রকম ভেবেছিল। ইতিহাস তো অতীতের এথনোগ্রাফির (নৃগোত্রতত্ত্ব) মতো। আমাকে অতীতের একজন মানুষের—ইংরেজিতে যাকে বলে—চামড়ার ভেতরে প্রবেশ করে তার ভয়ভীতি বুঝতে হবে। এই যে জয়া চ্যাটার্জি দেশভাগের ইতিহাস লিখেছেন, তিনি তো ঠিকই লিখেছেন যে হিন্দুরা বিভাজন চেয়েছিল। তারা ভয় পেয়ে সেটা চেয়েছিল। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা যেমন ইতিহাসের একটা নিয়ামক শক্তি, ভয়ও তেমনই একটা নিয়ামক শক্তি। সে ভয় ভুলও হতে পারে। ১৯৪৭ সালের পর বাঙালি ২০ বছর একসঙ্গে থাকলে একটা মারপিট করে হয়তো বোঝাপড়ায় চলে আসতে পারত।

গান্ধী ইংরেজদের বলেছিলেন, তোমরা চলে যাও। আমরা আমাদের বিষয়গুলো মীমাংসা করব। তার মানে কি গোড়ায় মারপিট হতে হবে? হয়তো। বিভাজনের ১০ বছর আগে যে বিক্ষোভ, যে দোষারোপ পরস্পরের মধ্যে হয়েছে, যে পর্যায়ে হয়েছে, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। বিভাজনের পর হয়তো প্রথম ১৫-১৬ বছর পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাগুরুর সঙ্ঘারামে থেকে আমাদের একরকম শান্তিতে কেটেছে। হিন্দুরা ভাব করত, আবার তোরা মানুষ হ। গিয়াছে দেশ, দুঃখ নাই। কিন্তু ইতিহাস যখন আমি লিখছি, আমার তো সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। আমার তো এটাও বুঝতে হবে যে ১৯৪৭-এর পর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা শিক্ষাদীক্ষায় আরও ‘হিন্দু’ হয়েছে। এর ফল কি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের জন্য ভালো হলো? আমার তো মনে হয় না। আজ ৭৫ বছর বাদে দেশভাগ আর তার ফলাফলকে যথাসম্ভব নির্মোহভাবে দেখা দরকার। অতীতের মানুষের ভুলভ্রান্তি নৈতিকভাবে বিচার করার জন্য নয়, কিন্তু তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষা-ভীতি ইত্যাদি বোঝার জন্য। আমার বর্তমানের সঙ্গে এটাকে যত না মেশাতে পারব, সেটাকে যত অতীতের জিনিস বলে দেখতে পারব, ততই এর মধ্যে আমার বর্তমানের সংস্কার কম আসবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ইতিহাসকে দেখার এই চোখটা পাওয়ার উপায় কী?

দীপেশ: আজ আমি যদি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আবেগ থেকে বা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আবেগ থেকে প্রমাণ করতে চাই যে হিন্দুরাই ছিল সবচেয়ে ক্ষতিকর, তাহলে সেই সওয়াল-জবাবের কোনো শেষ নেই। আমি অবশ্য মনে করি, হিন্দুদের আরও অনেক উদারতা দেখানোর প্রয়োজন ছিল। চিত্তরঞ্জন দাশের দূরদৃষ্টি ছিল, মুসলমানদের ভালোবেসেই তিনি কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তবে সেটা কার্যকর ছিল না। অপরিচয় আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে। ধরুন, আমি তো আমার চারপাশে বোরকা-সজ্জিত নারীদের দেখে বড় হইনি। তাই যখন তাদের দেখি, আমি বুঝে ওঠার আগেই মনের মধ্যে কোথাও এসে ধাক্কা লাগে। আমি একে সচেতনভাবে প্রশ্রয় দিই না। সংবেদনশীলতার মধ্যে প্রাপ্তিস্বীকার থাকতে হবে। এটা বন্ধুত্বের পটভূমি ছাড়া হয় না। বন্ধুত্বের ভালোবাসা বা বিশ্বাসের কারণে আমি আপনাকে আমার ধাক্কা লাগার কথাটা বলতে পারলাম। আমি অনেক নারীকে দেখি একদম গ্রামাঞ্চলের। তাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি জানি না কীভাবে তাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করতে হয়। অথচ আধুনিক কোনো নারীর সঙ্গে সহজেই বিভিন্ন বিষয়ে আমরা কথা বলতে পারি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তোমাদের কথা লিখব কী করে? তোমরা তো মেয়েদের বাইরে আনো না। এখন তো মেয়েরা বাইরে আসছে৷ ইতিহাসে চেনা-অচেনার মধ্যে এই যে একটা আলোছায়ার খেলা চলে, তাকে ইতিহাসের মধ্যে আনতে হবে। আমি সব সময় বলি, আমাদের শিখতে হবে। ঐতিহাসিক কারণেই বাঙালি মুসলমান হিন্দুর আচার বা ধর্ম সম্বন্ধে বেশি জানে, কিন্তু হিন্দু মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে জানে অনেক কম। বাংলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্কে হয়তো এই কথাটা আর সত্য নয়। ধর্মটাকে জানতে হবে, ভাষাটাকে জানতে হবে, ঘরের কথা জানতে হবে। আমার চোখে স্বপ্নের বাংলাভাষী মানুষ তারাই, যারা ক্রমাগত পার্থক্য মীমাংসা আর নৈকট্য রচনার জন্য আলোচনা বা তর্ক করতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাঙালির যে ধারণা উনিশ শতকে কলকাতায় তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের জায়গা ছিল না। এরপর নানা ভেদ-বিচ্ছেদ-বেদনার মধ্য দিয়ে দেশভাগ হলো। এরপর মুসলমান বাঙালি আরেকটা ইতিহাস রচনা করল। নানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিল তারা। ভারত বা বাঙালির বৃহত্তর পটভূমিতে এ ভূখণ্ডে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আলাদা কোনো তাৎপর্য কি আপনার চোখে পড়ে?

দীপেশ: আলাদা তাৎপর্য তো অবশ্যই আছে। এটা একটা স্বপ্নের মতো। এই স্বপ্নটা আমি সব সময় শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে লক্ষ করেছি। আবুল মনসুর আহমদের মধ্যেও সে স্বপ্নটা ছিল। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসটা যেভাবে দেখা হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে তার একটা ভিন্নতর আখ্যানের জায়গা থেকে গেছে। বাঙালি মুসলমান এমন একটা সমাজ চেয়েছিল, যেখানে তাদের ওপরে শোষণ হবে না। আর মুসলমানরা যেহেতু সাম্যে বিশ্বাস করে, তারা কারও ওপর শোষণ করবে না। দ্বিতীয় প্রস্তাবনাটা একটা অসম্ভবের স্বপ্ন। অসম্ভবের দেশে যাওয়া তো সমাজতন্ত্রেরও স্বপ্ন ছিল। এ অসম্ভবের স্বপ্ন কিন্তু মরে যায়নি। বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রশ্নে বাঙালি না বাংলাদেশি এই বিতর্ক আছে। বাংলাদেশে এ বিতর্ক ১৯৭২ সালের সংবিধান থেকে ক্রমেই বিবর্তিত হয়েছে। এ বিবর্তনের জায়গা থাকাটা প্রমাণ করে যে কোনো একটা পর্যায়ে বৃহত্তর আত্মপরিচয়ের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা আছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় পরপর পূর্ব অংশের মানুষ বাঙালি আত্মপরিচয়টাকে ক্রমাগত সামনের দিকে এনেছে। নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি ধারণার নতুন একটা বিবর্তনও তারা ঘটিয়েছে। বাঙালির ধারণার কি নতুন কোনো প্রসার এখন সম্ভব?

দীপেশ: কলকাতার পয়সাওয়ালা বাঙালি বুঝে গেছে যে হিন্দি আর ইংরেজি তার সফলতার পথ। আমার একজন বন্ধু বলে, যে ভাষায় জীবন যাপন করার জন্য পর্যাপ্ত রোজগার করা যায়, সেটাই হলো জীবন্ত ভাষা। আর্থিক যোগ ছাড়া ভাষা জীবন্ত রাখা মুশকিল।

অবশ্য দুই দিকের বাঙালির অনেক বিষয়ে যেমন বৈপরীত্য আছে, তেমন মিলও আছে। যে আবেগ দিয়ে আপনি ‘ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,/ দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ’ গাইবেন, আমি গাওয়ার সময় কি হলফ করে বলা সম্ভব আপনার-আমার আবেগের মধ্যে কোনো মিলনবিন্দু নেই? শঙ্কাহরণের হিন্দু গল্প কি আপনার মধ্যে নেই? এটা চলে আসে। তৃতীয় চোখের ধারণা বা এর মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা আবেগ তো মুহূর্তে তৈরি হয়নি। এতে রূপান্তরের গল্প আছে, কন্যাস্মৃতির গল্প আছে, পাশাপাশি থাকার গল্প আছে।

জগতে মানুষ কীভাবে আনন্দে থাকবে, আমি মনে করি সব ধর্মেই তার একটা সূত্র আছে। বাংলায় ইসলাম এসেছে। ইসলামও আমাকে শেখাবে। ইসলাম তো আমাকে শিখিয়েছে। সুফিবাদও শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সুফি ধারণা নানাভাবে এসেছে। তাঁর বাবার আত্মজীবনী সুফিদের কবিতা দিয়ে ভরা। যেভাবেই আমরা ইতিহাস লিখি না কেন, একটার ওপর একটা এসে নানা জায়গায় মিলবেই। আপনি যে হিন্দু, আমিও যে মুসলমান—এটা স্বীকার করতে হবে। অজান্তেই আপনার মধ্যে হিন্দুধর্ম আছে, অজান্তে আমার মধ্যেও ইসলাম ধর্ম আছে। কোনো গোঁড়া ধর্মবাদী মানবে না, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বলে আমার কাছে কোনো স্পষ্ট ভেদরেখা টানা নেই। আমার কাছে তৃতীয় পরিসর মানে এটা বুঝতে পারা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে আপনি লিখেছিলেন, বাঙালি মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী হিন্দু স্মৃতিতে একটি খলচরিত্র। এর মানে আমাদের ঐতিহাসিক স্মৃতি খণ্ডিত হয়ে আছে। বিচ্ছিন্ন এই দুই স্মৃতিকে কি এক সুতায় গাঁথা সম্ভব?

দীপেশ: সেই চেষ্টা আমাদের করে যেতে হবে। খণ্ডিত হওয়ার ইতিহাস তো অস্বীকার করলে হবে না। ১৯৪৭ সালের পর পাঠ্যবই আলাদা হয়ে গেল। পাকিস্তান আর ভারতের পাঠ্যবইয়ে যে ইতিহাস বলা হলো, আমাদের বাবা-মায়েরা যে ইতিহাস বলছেন, তা তো সত্যিই খণ্ডিত হওয়ার ইতিহাস। এই খণ্ডিত ইতিহাসের মধ্যে যারা বড় হয়েছে, তাদের মনেও সেই বিচ্ছিন্নতা রয়ে গেছে। এই যে পরস্পরের মধ্যে মিলেমিশে থাকা জায়গাটা আমি ধরার চেষ্টা করছি, বলছি যে নিজের অজ্ঞাতসারেই সাংস্কৃতিকভাবে আমি একজন মুসলমান—এখানেই সেই পরিসর। এটা কাউকে অপমান করার বা কাউকে ছোট করার বিষয় নয়। এই মাইনোরেটারিয়ান কালচারের পথে যারা আসতে রাজি হবে, তারাই মিলনের ক্ষেত্রটা দাঁড় করাতে পারবে।

মিলন মানে কিন্তু শুধু ঐকতান নয়, খালি ভাব-ভালোবাসা নয়। মিলন মানে আমাদের যে মধ্যে ঝগড়া হয়েছে, সেটিও স্বীকার করে নেওয়া। অতীতের কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঝগড়া হয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করা। অতীতের মানুষটাকে এ নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তার ভয় পাওয়ার অধিকার ছিল। পাকিস্তান কেন হলো? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অব নেশনস একটা সংখ্যালঘুর দলিল তৈরি করল। অনেক গোষ্ঠী ছিল যারা কোনো রাষ্ট্র পায়নি, যেমন কুর্দিরা। বলা হলো, সংখ্যালঘুদের অধিকার দিতে হবে। এটা শুনে সাভারকার প্রমুখ ভাবলেন, তাহলে তো মুসলমানদেরও অধিকার দিতে হবে। তিনি হিন্দুত্ব লিখতে শুরু করলেন। বললেন, তোমরা মুসলসানরাও হিন্দু। সে জন্যই বলছি, তৃতীয় একটা পরিসর তৈরি করতে হলে আগে বন্ধুত্ব করতে হবে, বিশ্বাসী হতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি তো ইতিহাস চর্চা করেন। সে দৃষ্টিতে বাঙালির ভবিষ্যৎ দেখেন?

দীপেশ: আশু ভবিষ্যৎ আমার কাছে ভালো বলে মনে হয় না। আপনাদের তবু একটা রাষ্ট্র আছে। বেশি দিন সময় পাবেন। পৃথিবীর যে সমস্যা, সেটা সার্বিক হলে হয়তো আরও কিছু সুবিধা হবে। আমি পশ্চিমে গিয়ে বেঁচে যাব, আমাদের সন্তানদের সেখানে পাঠিয়ে দিলে ওরা ঠিক থাকবে—এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা এখনো মানুষের মধ্যে আছে। অথচ পশ্চিম এখন পড়তির দিকে। পরিবেশ সংকটও এতটাই প্রকট হয়ে উঠবে যে কেউ তা থেকে রক্ষা পাবে না। এর ইতিবাচক ফল হতে পারে এই যে মানুষ ভিন্ন রকম অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবে।

যে ধনতন্ত্রের রমরমাতে আমরা সবাই উঠে আসছি, এই যে চীন-ভারতের উন্নয়নের গল্প, আপনার-আমার মতো নতুন মধ্যবিত্তের উত্থানের গল্প, এর উল্টো পিঠই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। ভোগী শ্রেণির বড় অংশ এখন ভারত, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়; পশ্চিমে নয়। পানি বা বায়ুর দূষণ বা পাহাড় ধ্বংসের মতো বিষয়গুলো চিরকাল চলতে পারে না। আমি আশাবাদী, আর কয়েক দশকের মধ্যেই মানুষ এসব বিষয়ে আরও সচেতন হবে। পরিবেশের সমস্যাজনিত দুঃখকষ্ট তো আছেই, কিন্তু এটাও ঠিক যে মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। দেরিতে হলেও নেয়। সেই সূত্রে আমি আশাবাদী।