বিচারকাজ শেষ হয়নি, যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি আহতরা

রাজধানীর তোপখানা সড়কে সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রানা প্লাজা ভবন ধসের ১০ বছর: কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও শ্রমিকের সুরক্ষা’ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় বক্তারা
ছবি: প্রথম আলো

সাভারে রানা প্লাজা ধসের ১০ বছর পরও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। অনেক শ্রমিক কর্মক্ষমতা হারালেও যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি। আহত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও আর্থিক অবস্থার দিকেও কারও নজর নেই। অনেকেই পরিবারের বোঝা হওয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। আর্থিক অনটনের কারণে স্কুলপড়ুয়া সন্তানকেও কাজে পাঠাচ্ছেন অনেকে। রানা প্লাজা ভবন ধসের মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির পাশাপাশি আহত শ্রমিক ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

সোমবার রাজধানীর তোপখানা সড়কে সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রানা প্লাজা ভবন ধসের ১০ বছর: কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও শ্রমিকের সুরক্ষা’বিষয়ক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।

রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক পরিস্থিতির পুনর্মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে সভায় অভিমত উঠে আসে। বক্তারা বলেন, শ্রম আইন সংস্কার করে যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। রানা প্লাজা ধসের পর কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় এলেও পরবর্তী ১০ বছরে এ ক্ষেত্রে খুব বেশি উন্নতি হয়নি। অর্থাৎ পরিস্থিতি আগের মতোই আছে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকেরা আহত হলে তাঁদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলার দাবিও তোলা হয়।

মতবিনিময় সভায় রানা প্লাজা ভবন ধসে আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারানো তিন নারী বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে শুধু কর্মক্ষমতা হারাননি, পরিবারের বোঝা হয়ে দুর্বিষহ জীবন পার করছেন বলে জানান। তাঁদের একজন রাজিয়া বেগম। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় তিনি বাঁ হাত, দুই পা ও মাথায় গুরুতর আঘাত পান। তিনি কাজ করতে পারেন না। এখন তিনি সপ্তাহে তিন দিন সাভারের সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) হাসপাতালে থেরাপি নিতে হয়। এখন তিনি পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়েছেন। আহত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন। আর কোনো সহায়তা তিনি পাননি। কর্মস্থলে আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারানোর ক্ষতিপূরণ ১০ হাজার টাকা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।

সভায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসের মামলার বিচার আরও আগেই শেষ হওয়া উচিত ছিল। অতি শিগগির এ মামলার বিচার শেষ হওয়া উচিত। সমাজপতি হিসেবে যাঁরা আছেন, যাঁরা সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের উচিত রানা প্লাজা ধসে অর্ধমৃত অবস্থায় বেঁচে থাকা শ্রমিকদের দিকে নজর দেওয়া উচিত।

শ্রমিকদের সুরক্ষায় কঠিন আইন করার পাশাপাশি যারা আইন ভঙ্গ করবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে বলে মত দেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান। তিনি বলেন,  রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডে এখনো কিছু টাকা আছে। যাঁরা আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে পারছেন না, তাঁরা যোগাযোগ করলে সেই ফান্ড থেকে অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করবেন।

শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন বলেন, আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সহায়তা একবার দেওয়া হয়েছে, সেটা যথেষ্ট ছিল না। দুর্ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা এবং যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের একটি আলোচনা ছিল। এ আলাপ-আলোচনাটা এখনো চালিয়ে যাওয়া উচিত। প্রয়োজনে গণমাধ্যমের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে।

মতবিনিময় সভায় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হাজেরা খাতুন। তিনি এসব দাবির বিষয়ে বলেন, শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে সরকার আন্তরিক। শ্রমিকদের অধিকারের কথা বিবেচনা করে সরকার শ্রম আইন এরই মধ্যে দুবার সংশোধন করা হয়েছে। আবারও সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। সভায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো তিনি তাঁর মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সামর্থ্যের বিষয়টিও দেখতে হবে।’

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্লাস্টের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধস থেকে শুরু করে সর্বশেষ বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন—এসব ঘটনায় কারও না কারও অবহেলা আছে। যাঁদের অবহেলা আছে, তাঁদের খুঁজে বের করা উচিত। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে অবহেলার কারণে। এভাবে একটি দেশের সিস্টেম (ব্যবস্থা) চলতে পারে না।
সভায় ‘রানা প্লাজা ভবন ধসের ১০ বছর: কর্মস্থলের নিরাপত্তা শ্রমিকের সুরক্ষা’বিষয়ক একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন ব্লাস্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সিফাত-ই নূর খানম এবং সেফটি অ্যান্ড রাইটসের আইন কর্মকর্তা হাসিনা খানম।

সভায় আরও বক্তব্য দেন স্টেট ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক এম হাসনাত আলমগীর, আইনজীবী সেলিম আহসান খান, সেফটি অ্যান্ড রাইটসের নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী এবং ব্লাস্টের পরিচালক (আইন) বরকত আলী।

সভা সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।