‘বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে দরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’

অতিথিদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন আবুল মনসুর আহমদ প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কারপ্রাপ্তরা। বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভোটারদের সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের যে লক্ষ্য, সেটি অর্জনে একটি বিষয়ই দরকার, সেটি হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই গণতন্ত্রের পথে অনেক বাধা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক বিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশকে এর থেকে সবক নিতে হবে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে প্রখ্যাত রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের লেখা বই ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর: পাঠ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক আলোচনায় আকবর আলি খান এসব কথা বলেন।

আকবর আলি খান বলেন, দেশে পরোক্ষ গণতন্ত্রকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে রূপান্তর করতে হবে। কারণ, পরোক্ষ গণতন্ত্রে বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়। নির্বাহী বিভাগ, সংসদ, বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন করতে হবে। এখন দেশের সব রাষ্ট্রীয় অঙ্গ নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে রয়েছে। নির্বাহী বিভাগের এ ধরনের কর্তৃত্ব থাকলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তন, ভোটব্যবস্থার সংস্কার, শাসনতান্ত্রিক বিধান ছাড়াই গণভোটের প্রবর্তন, ভোটের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। তিনি এ বিষয়ে গণতন্ত্রের সমর্থকদের নিরন্তর গবেষণার পরামর্শ দেন।

এখন দেশের সব রাষ্ট্রীয় অঙ্গ নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে রয়েছে। নির্বাহী বিভাগের এ ধরনের কর্তৃত্ব থাকলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে
আকবর আলি খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

আবুল মনসুর আহমদের বই থেকে উদ্ধৃত করে আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদের চূড়ান্ত সমাধান হলো সংবিধান গণতান্ত্রিক হতে হবে। তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনার সময়েও আমি বলিয়াছিলাম, পাকিস্তানে ইসলাম রক্ষা না করিয়া গণতন্ত্র রক্ষার ব্যবস্থা করুন। গণতন্ত্রই ধর্মের গ্যারান্টি। বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় আমি বলিয়াছিলাম, বাংলাদেশের সমাজবাদের কোনো বিপদ নাই। যত বিপদ গণতন্ত্রের, গণতন্ত্রকে রোগমুক্ত করুন, সমাজবাদ অবশ্যই সুস্থ হইয়া যাইবে।’

আবুল মনসুর আহমদের লেখার সঙ্গে একমত পোষণ করে আকবর আলি খান বলেন, ‘আমি একটু বিস্মিত হয়ে গেছি, আমি বেশ কিছু ধরেই এ কথাগুলো বলে আসছি। আমি মনে করেছি, এগুলো আমার বক্তব্য। দেখলাম, আমি আবুল মনসুর আহমদের বক্তব্যই প্রচার করছি। আমাদের সংবিধানে চারটি স্তম্ভ আছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। আমার বক্তব্য হলো, যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে টেকসইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করা সম্ভব নয়।’

আকবর আলি খান বলেন, সমাজতন্ত্রের জন্যও গণতন্ত্র প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে যে সমাজতন্ত্র, সেটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এবং সেটি টেকসই না–ও হতে পারে। আর বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ লালিত–পালিত এবং বিকশিত হয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে। সুতরাং বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে একটি বিষয়ই দরকার, সেটি হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।

আকবর আলি খান বলেন, ‘বাংলাদেশ কোনো ভুঁইফোড় রাষ্ট্র নয়। ১৯৫০ সালে গোটা পৃথিবীতে ৩৮টি রাষ্ট্র ছিল। ১৯৬১–এর পর ১৩৮টি, ২০১৫ সালে ২০৩টি রাষ্ট্র হয়। বাংলাদেশ হওয়ার পরে ৫৮টি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। আরও হবে কি না, আমরা জানি না। বিশ্বে বর্তমানে যে পরিবর্তন হচ্ছে, এর ফলে নতুন নতুন জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদের দাবি নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটছে।’

আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আবুল মনসুর আহমদ নিরপেক্ষ ছিলেন না, তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন। যেমন তিনি বইয়ের নাম দিয়েছেন, বেশি দামে কেনা, অল্প দামে বেচা স্বাধীনতা। এই যে স্বাধীনতা বিক্রি হয়ে গেল, কোথায়, কার কাছে গেল। আজকে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে, এই পঞ্চাশ বছর পরে এবং পাকিস্তানের ওই ২৩ বছরের ইতিহাস পার হয়ে এসে আমরা বুঝি, স্বাধীনতা চলে গেছে পুঁজিবাদের কাছে। এই যে স্পষ্ট কথা তিনি বললেন, স্বাধীনতা বেচা হয়ে গেছে। সেটাই এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্টভাবে।’

আলোচনায় আরও অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ বিন আলী।

সভা শেষে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে পঞ্চমবারের মতো আবুল মনসুর আহমদ প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয়৷ এতে তিনটি বিষয়ে ৯ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। এর মধ্যে শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে আবুল মনসুর আহমদের ভূমিকা বিষয়ে মীর মুনতাসির হোসেন প্রথম, প্রতীতি পিয়া দ্বিতীয় আর সুরাইয়া খানম তৃতীয় হন।

সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ বনাম আজকের সাংবাদিকতা বিষয়ে কানিজ ফাতেমা কনিকা প্রথম, মো. গোলাম মোস্তফা দ্বিতীয় আর জাহানারা বেগম মুক্তা তৃতীয়। বাঙালি সংস্কৃতিতে আবুল মনসুর আহমদের চিন্তা বিষয়ে মোহাম্মদ আবু সাঈদ প্রথম, নাফিস রায়হান দ্বিতীয় ও রিজভী আহমেদ তৃতীয় হন।

বিজয়ীদের হাতে নগদ অর্থ, সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আকবর আলি খান ও ইংরেজি ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক ও আবুল মনসুর আহমদের ছেলে মাহ্‌ফুজ আনামসহ অতিথিরা।