যেভাবে বঙ্গবাজারের প্রতিষ্ঠা, যেভাবে দুবার আগুনে ভস্মীভূত

আগুনে পুড়ে বঙ্গবাজার একটি বিধ্বস্ত স্তূপে পরিণত হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী ধ্বংসস্তূপে নিজেদের মালামাল খুঁজেছেন। বঙ্গবাজার, ঢাকা, ৬ এপ্রিল
ছবি: সাজিদ হোসেন

ঢাকার বঙ্গবাজারে প্রথম ভয়াবহ আগুন লেগেছিল ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর। তখন এখানে চারটি হকার্স মার্কেট ছিল। দোকানের সংখ্যা ছিল ৫২৫। এক আগুনে পুরো বঙ্গবাজার ছাই হয়ে গিয়েছিল। আগুনের ঘটনা নিয়ে পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে আট কলামজুড়ে শিরোনাম ছিল, ‘ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বঙ্গবাজার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত।’ মূল শিরোনামের একটু ওপরে লেখা ছিল, ‘অসহায় হাজার হাজার মানুষের সামনে ছাই হয়ে গেল টি হকার্স মার্কেট।’

আগুন লাগার ছবি ছিল একাধিক। আর ছিল দুটি বিশেষ ছবি। একদম ওপরে দুই পাশে সমানভাবে ছাপা হয়েছিল ছবি দুটি। একদম বাঁ দিকে দুই কলামে ছাপা ছবিটি ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। তিনি বঙ্গবাজার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। আর একদম ডান দিকের ছবিটি শেখ হাসিনার বঙ্গবাজার পরিদর্শনের। তিনি তখন প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী।

পরদিনও ইত্তেফাক ছয় কলামজুড়ে আগুন–পরবর্তী ঘটনা তুলে এনেছিল। শিরোনাম ছিল, ‘বঙ্গবাজারের দোকানীরা কবে আবার পসরা সাজাইতে পারিবেন বলা মুশকিল।’ দ্বিতীয় দিনের লেখাটি ছিল আসলে ব্যবসায়ীদের দুরবস্থার কথা নিয়ে। কারণ, প্রত্যেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন।

সেই বঙ্গবাজারও একসময় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। যদিও দুর্ঘটনা বা আগুন থেকে রেহাই পায়নি। ২০১৮ সালেও আরেকবার আগুন লেগেছিল। তবে ১৯৯৫ সালের পরে পুরো বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ার ঘটনা আবার ঘটল এবারই। সেবারও হতাহতের ঘটনা ছিল না, এবারও তা হয়নি। তবে সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের নিঃস্ব হওয়ার ঘটনা একই রকম। এমনকি ১৯৯৫ সালে ব্যবসায়ীদের আহাজারির সঙ্গে এবারের আহাজারির ধরনও একই রকম। আর তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, আর এবার করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের। তদন্ত কমিটি গঠন ও রিপোর্ট নিয়ে কী হয়, তা অবশ্য সবারই জানা।

বঙ্গবাজারের ইতিহাস

ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত এই বঙ্গবাজার মূলত তৈরি পোশাক বিক্রির একটি বাজার। তবে শুরুতে বঙ্গবাজার তৈরি পোশাকের বাজার ছিল না। বাংলাপিডিয়া বলছে, ১৯৬৫ সালে জায়গাটি নানা ধরনের খুচরা পণ্যের হকার ও ছোট দোকানদারদের ব্যবসায় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সে সময় ফুলবাড়িয়ার এই জায়গা ছিল ঢাকার প্রধান রেলস্টেশনের একেবারে সংলগ্ন এবং এ কারণে বাজারটিও হালকা খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও স্যুভেনির বিক্রির একটি আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছিল।

বাজার গড়ে ওঠার বছর চারেকের মধ্যেই ফুলবাড়িয়া থেকে রেলস্টেশন কমলাপুরে সরিয়ে নেওয়া হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের সংযোগস্থল হওয়ায় স্থানটির গুরুত্ব আগের মতোই রয়ে যায়। ফলে হকার ও অন্য দোকানদারেরা এখানে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেন। তাঁদের অনেকেই আবার অবৈধভাবে অস্থায়ী টিনশেড তৈরি করেন।

ভয়াবহ আগুনে বঙ্গবাজারের দোকানগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে
ছবি: সাজিদ হোসেন

বাংলাপিডিয়ার মতে, ১৯৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ সব ধরনের টিনশেড ও অস্থায়ী কাঠামো ভেঙে দিয়ে এখানে একটি পাকা বাজার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ জায়গাটির মালিকানা ছাড়তে অস্বীকার করলে দোকানমালিকেরা রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বার্ষিক ইজারা চুক্তির ভিত্তিতে খণ্ড খণ্ড জায়গায় নিজ নিজ দোকান বসানোর অধিকার লাভ করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে সিটি করপোরেশন জায়গাটির মালিকানা পায় এবং ১৯৮৯ সালের মধ্যে পরিকল্পিত পাকা বিপণিকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ করে। নতুনভাবে তৈরি বাজারটির মোট আয়তন ছিল ২১ হাজার ২৫০ বর্গফুট। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০—পাঁচ বছরেই মূলত বাজারটি তৈরি পোশাকের বাজার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। বাজারটি বঙ্গবাজার নামে পরিচিতি অর্জন করলেও এখানে গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ হকার্স মার্কেট নামের অন্য তিনটি সংলগ্ন বাজারের দোকানও একত্রে মিশেছে।

২০১৫ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী, বাংলাপিডিয়া বঙ্গবাজারের একটি বর্ণনাও দিয়েছে, যা এখনো প্রায় একই রকম আছে। বাংলাপিডিয়া লিখেছে, ‘বঙ্গবাজার থেকে অল্প দামে নানা রকম তৈরি পোশাক, পাদুকাসামগ্রী এবং শাড়ি কেনা যায়। এখানে এসব পণ্য খুচরা ও পাইকারি হারে বিক্রয় হয়। বিদেশি ক্রেতা ও তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের জোগান দেওয়া কাঁচামাল ব্যবহারের পর দেশের পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে যত কাপড়, সুতা, বোতাম, জিপার ইত্যাদি উদ্বৃত্ত থাকে, মূলত সেগুলি দিয়ে তৈরি বলে বঙ্গবাজারের পোশাক দামে সস্তা।

দেশে ট্রেডমার্ক আইন তেমন শক্ত নয় আর ডিজাইন ও সেলাই কৌশল নকলেও স্থানীয় দরজিরা খুবই দক্ষ বলে বঙ্গবাজারের পোশাকসামগ্রী বিদেশি লেবেলে চালিয়ে দেওয়া হয়। তবে পোশাকগুলি গুণগতভাবেও উন্নত। ঢাকার সিদ্দিকবাজার, তাঁতিবাজার, বাংলাবাজার, বংশাল এবং অন্যান্য এলাকার অনেক স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের শোরুম বা সেলস কাউন্টার হিসেবেও বঙ্গবাজারে অনেক দোকান আছে। মোট ২,২০০ দোকানের জন্য বঙ্গবাজারের পরিসর অপ্রতুল বলে এর ভেতরে দোকানের সারিগুলি অপ্রশস্ত। অনেক সময় ক্রেতার ভিড়ে ভেতরটা হয়ে ওঠে অসহ্য।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতা ছাড়াও খুচরা ও পাইকারি ভিত্তিতে পোশাকসামগ্রী কেনার জন্য এখানে আসে ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া, ইরান ইত্যাদি দেশের ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ক্রেতারা। বাংলাদেশে অবস্থিত অনেক দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিদেশিরাও এ বাজারে প্রায় নিয়মিত আসে। এভাবে বঙ্গবাজার দেশের বাইরেও পরিচিতি অর্জন করেছে। প্রতিদিন বঙ্গবাজারে আসা বিদেশি ক্রেতাকে সাহায্য করতে অল্পবয়সী স্বশিক্ষিত অনেক দোভাষীকে বাজারের ভেতর সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। বিদেশি কোনো ভাষাতেই এদের তেমন দক্ষতা না থাকলেও দরদাম এবং পোশাক–পরিচ্ছদের নাম, রং ও সাইজ বোঝানোর জন্য দরকারি বিদেশি ভাষায় এরা যথেষ্ট পারদর্শী।’

আরও পড়ুন

আবার আগুন

১৯৯৫ সালের আগুন লাগার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের অদক্ষতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। এবার বলা হচ্ছে এলাকাটি যে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় সংসদে গতকাল বৃহস্পতিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান ৩০০ বিধিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, নোটিশ দিলেও ব্যবসায়ী সমিতি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেই সঙ্গে স্থগিতাদেশ বহাল থাকায় মার্কেটটি ভাঙা বা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি।

তিনি আরও জানিয়েছেন, ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন বঙ্গবাজার মার্কেটের প্রায় ১ দশমিক ৬৯৭ একর জমি পায়। ১৯৯৫ সালে মার্কেট সমিতি নিজ খরচে তিনতলাবিশিষ্ট বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটটি নির্মাণ করে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১৬ সালের ৭ আগস্ট ওই স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে ১৪১টি গাড়ি পার্কিং ও ৪ হাজার ৪১৩টি দোকানঘরের সংস্থান রেখে প্রতিটি ফ্লোরে ৬৭ হাজার ৩৩২ দশমিক ৫৩ বর্গফুট ধরে ১০ তলা ভিত্তিবিশিষ্ট স্টিল স্ট্রাকচার বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ। ইজিপি প্রক্রিয়ায় সর্বনিম্ন দরদাতাকে ২০১৯ সালের জুন থেকে শুরু করে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

২০১৯ সালে কর কর্মকর্তা কর্তৃক বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতিকে সংশ্লিষ্ট মার্কেটটি ৩০ দিনের মধ্যে খালি করে দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। নিষেধাজ্ঞা চেয়ে সংশ্লিষ্ট মার্কেট থেকে তিনটি মামলা করা হয় এবং চিঠির কার্যকারিতা হাইকোর্ট স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন, যা বারবার সময় বাড়িয়ে অদ্যাবধি বহাল আছে।