পা হারিয়ে দিশেহারা নাইক্ষ্যংছড়ির দুই কৃষক

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আব্দুল কাদের
ছবি: গাজী ফিরোজ

হাঁটুর নিচ থেকে ডান পা নেই। ব্যান্ডেজে বাঁধা কোমরের নিচ থেকে হাঁটু পর্যন্ত। পুরো মুখে স্প্লিন্টারের ক্ষত। বাঁ হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আরও ক্ষত। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রোহিঙ্গা নাগরিক আবদুল কাদের (৫১)। কিছুক্ষণ পরপর চোখ খুলে তাকাচ্ছেন আর বলে যাচ্ছেন, ‘আমার সংসারের কী হবে। স্ত্রী-সন্তানেরা কীভাবে চলবে।’

গতকাল বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে কাদেরকে এভাবে দেখা গেছে। আগের দিন মঙ্গলবার দুপুরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়নের ছেড়াকুম এলাকার বিপরীতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার শূন্যরেখায় স্থলমাইন বিস্ফোরণে কাদেরের ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাদের নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ছেড়াকুম এলাকায় বাস করলেও বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন তিনি।

এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে বিস্ফোরণে অংথোয়াই তঞ্চঙ্গ্যা নামের এক তরুণও বাঁ পা হারিয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কাদেরের মতো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই তরুণ যন্ত্রণায় ভুগছেন। দুজনই গরু আনতে গিয়ে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে পা হারান। সীমান্তে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তিনটি মাইন বিস্ফোরণে দুজনের পা বিচ্ছিন্ন হয়। এ ছাড়া এক রোহিঙ্গা কিশোরের মৃত্যু হয় এবং আহত হন আরও এক রোহিঙ্গা।

রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পাহাড়ে টানা দুই মাস ধরে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির (এএ) তুমুল সংঘর্ষ চলছিল বলে খবর পাওয়া গেছে। আরাকান আর্মির আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে রাত ও দিনে ছোড়া হচ্ছিল মুহুর্মুহু গুলি ও অসংখ্য মর্টারের গোলা। আতঙ্কে রয়েছে এপারের বাসিন্দারা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অংথোয়াই তংঞ্চঙ্গ্যা
ছবি: গাজী ফিরোজ

চমেক হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ২২ নম্বর শয্যায় আছেন আবদুল কাদের। বাঁ হাতে স্যালাইন লাগানো। পুরো মুখে ও হাতে স্প্লিন্টারের দাগ। কিছুক্ষণ পরপর চোখে খুলে ডান পায়ের দিকে তাকাচ্ছেন। আর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।

কাদের বলেন, ডান পা না থাকায় আগের মতো খেতখামারে কাজ করতে পারবেন না। তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের কী হবে এখন।

হাসপাতালে কাদেরের পাশে বসে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ফুফাতো ভাই মো. হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পানের বরজ ও খেতখামারে কাজ করে সংসার চালান কাদের। তাঁর তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছেন। সন্তানেরা এখনো ছোট। ঘটনার দিন তাঁর ডান পা বিস্ফোরণে উড়ে গেছে।

কাদেরের ফুফাতো ভাই মো. হোসেন জানান, ১৯৯১ সালে মিয়ানমার থেকে তাঁরা বাংলাদেশে আসেন। মঙ্গলবার নাইক্ষ্যংছড়ির ছেড়াকুম সীমান্তের শূন্যরেখায় গরু আনতে গিয়ে কাদের স্থলমাইন বিস্ফোরণের শিকার হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি সেখানে পড়েছিলেন। বিকেলে খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পরে সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ওই দিন রাতে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

কাদেরের মতো পা হারানো আরেক কৃষক চমেক হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৩ নম্বর শয্যায় ১৯ দিন ধরে আছেন অংথোয়াই তঞ্চঙ্গ্যা। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাঁটুর নিচ থেকে বাঁ পা কেটে ফেলে দেওয়া হয়। এখনো ব্যথায় ঘুমাতে পারি না। কবে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে যাব জানি না।’ এক পা দিয়ে কীভাবে কৃষিকাজ করবেন, সেই চিন্তায় আছেন অংথোয়াই।

হাসপাতালে ছেলের শয্যার পাশে বসে আছেন বৃদ্ধ মা ইয়াং মে তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২২ বছর বয়সে তাঁর ছেলে এক পা হারিয়ে ফেলেছেন। এখনো বিয়ে করেননি। ছেলে দিনমজুরের কাজ করার পাশাপাশি কৃষিকাজ করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে সংসার চলত। ছেলের পা হারানোয় এখন তাঁরা দিশেহারা।

পা হারানো দুজনকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা চলছে বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল কাদেরের ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। তাঁর চোখেরও সমস্যা রয়েছে। বাকি অংশটুকু ড্রেসিং (পরিষ্কার) করা হচ্ছে। এরপর পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন চিকিৎসকেরা। অংথোয়াই তঞ্চঙ্গ্যারও সুস্থ হতে আরও কিছুদিন লাগবে বলে জানান তিনি।