হাজার বছরের তালপাতার পুঁথি

রাজশাহীতে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত হাজার বছরের প্রাচীন তালপাতার পুথি ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

পুঁথির বয়স প্রায় হাজার বছর। তালপাতায় লেখা। পাতায় পাতায় আঁকা রঙিন ছবি। এখনো সেই ছবি যেন কথা বলছে। রং-রেখায় জীবন্ত হয়ে আছে। এতটুকু মলিন হয়নি। পুঁথির নাম অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অতি অনুসরণীয় ও সম্মানিত এ গ্রন্থ একাদশ ও দ্বাদশ শতকে লেখা। সচিত্র এ দুটি পুঁথি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। আট হাজার লাইনে লেখা একটি পুঁথিতে ছয়টি ও অপরটির ৪৯টি পাতায় দেব-দেবীর ৪৯টি রঙিন ছবি স্থান পেয়েছে।

অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার ইংরেজি অনুবাদ করা হয়, ‘পারফেকশন অব উইজডম ইন এইট থাউজেন্ডস লাইনস’। যার বাংলায় অনুবাদ করা যেতে পারে ‘পরিপূর্ণ জ্ঞানের আট হাজার পঙ্‌ক্তি’। বস্তুত সংস্কৃত শব্দ ‘অষ্ট’ অর্থ আট, ‘সাহস্রিকা’ অর্থ হাজার; অর্থাৎ অষ্টসাহস্রিকা শব্দের অর্থ হলো আট হাজার।

আবার ‘প্রজ্ঞা’ অর্থ জ্ঞান ও ‘পারমিতা’ অর্থ কর্তব্য–সম্পর্কিত দর্শন। এ নিয়ে বরেন্দ্র জাদুঘরের কর্মকর্তা মো. আবদুল কুদ্দুস পুঁথি দুটি নিয়ে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর পত্রিকার দশম সংখ্যায় একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন।

প্রাচীন তালপাতার পুঁথি ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’।
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর লোকনাথ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক সংস্কৃত পণ্ডিত সচীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত ১৯৭৯ সালে বরেন্দ্র জাদুঘরের ক্যাটালগ গ্রন্থ প্রস্তুত করেন। এর মধ্যে ক্যাটালগ ৬৮৯ ও ক্যাটালগ ৮৫১—এ পুঁথি দুটি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা

৬৮৯ ক্যাটালগভুক্ত পুঁথিটি তালপাতার উভয় পৃষ্ঠায় ছয় সারি করে লেখা। পুঁথির প্রতিটি পাতার দৈর্ঘ্য ৫৫ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ৫৫ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। এ পুঁথির লিপিকার শিলাদিত্য। এর ভাষা সংস্কৃত, যা কখনো কখনো অশুদ্ধ সংস্কৃত বলে সচীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, পুঁথির এক–সপ্তমাংশ পদ্য ছন্দে ও বাকি অংশ গদ্যে রচিত।

আট হাজার পঙ্‌ক্তিতে এ পুঁথি রচিত হয় একাদশ শতকের শেষ দিকে রাজা হরিবর্ম দেবের ১৯তম রাজ্যবৎসরে। সচীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত প্রণীত ক্যাটালগ গ্রন্থে রাজা হরিবর্ম দেবের রাজত্বকাল আনুমানিক একাদশ–দ্বাদশ শতাব্দী বলে উল্লেখ করা হলেও গবেষক ক্লাওডিন বুজ-পিক্রন এ সময়কাল এগারো শতকের শেষ ভাগ বলে তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। বৌদ্ধ মহাযান মতাবলম্বীদের ছয়জন দেব-দেবীর রঙিন ছবি এ পুঁথিতে আঁকা রয়েছে। গবেষকদের কেউ কেউ এ পুঁথিকে সম্পূর্ণ, আবার কেউ অসম্পূর্ণ বলে মতামত দিয়েছেন।

সচীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত প্রণীত ক্যাটালগ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত জাদুঘরের দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থটিও তালপাতায় লেখা। পুঁথির পাতাগুলো ৩১ দশমিক ৫০ বাই ৬ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার আকারের। এই পুঁথির বিস্তারিত বিবরণ ও আঁকা ছবিগুলোর বিশ্লেষণ বিষয়ে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বা এমনকি অন্য কোনো ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে বলেও জানা যায় না। ৫৩১টি পাতায় সম্পূর্ণ এ পুঁথির ৫১৯টি পাতা বর্তমানে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। বাকি ১২টি পাতা ‘নিরুদ্দিষ্ট’ বলে জাদুঘরের ক্যাটালগ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পুঁথির ৫১৯টি পাতার মধ্যে ৪৯টি পাতায় বৌদ্ধ মহাযান মতাবলম্বীদের বিভিন্ন দেব-দেবীর ৪৯টি রঙিন ছবি রয়েছে।

পুঁথির প্রতিটি পাতাই আকর্ষণীয়। চোখ ফেরানো যায় না। তার মধ্যে ৬৮৯ ক্যাটালগের ৯১ পাতার সম্মুখভাগের পীত রঙের অষ্টভূজা ছবিটি যেন দেখেও শেষ করা যায় না। একই ক্যাটালগের ২ নম্বর পাতার পীত রঙের প্রজ্ঞাপারমিতা ছবিটিও যেন অনেক কথা বলে। ৮৫১ ক্যাটালগের ২৯ পাতার ছবিটির বর্ণনা দিয়ে যেন শেষ করার মতো নয়। ছবিটি শুভ্রবর্ণের। ষষ্ঠ বাহুবিশিষ্ট দেবমূর্তি। তাঁকে লাল পদ্মের ওপরে বজ্রাসনে দেখা যায়, যাঁর মাথা সাদা কাঠামোর মধ্যে হলেও অন্তর্ভাগ লালাভ।

প্রচুর অলংকারশোভিত জটাধারী দেবমূর্তির মাথার ওপরে পঞ্চখাঁজের মুকুট স্থাপিত। ছয় হাতের মধ্যে প্রধান দুটি হাত বুকের ওপরে রাখা। তাতে বজ্র ও ঘণ্টা ধারণ করে বজ্রহুংকার মুদ্রা প্রদর্শিত হয়েছে। অপর দুটি বাঁ হাতের একটি তরবারির আস্ফালন ও অন্যটি শস্যমঞ্জরি ধারণ করে আছে। ত্রিনেত্রবিশিষ্ট এ দেবমূর্তির অবয়ব আপাতদৃষ্টে শান্ত মনে হলেও চক্ষু বিদ্বেষপূর্ণ। ছবিটি যেন ষোড়শ শতকে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার হাসির সঙ্গে বিষণ্নতা মেশানো অমর সৃষ্টির কথাই মনে করিয়ে দেয়। পাতা ওলটাতে ওলটাতে হারিয়ে যেতে হয় হাজার বছর আগের পাল বংশের রাজত্বে।

এ দুর্লভ পুঁথি দুটি দেখে যে কারও মনে হতে পারে এ অমূল্য শিল্পের সন্ধান কে দিয়েছিলেন। তা কিন্তু জাদুঘরের কোথাও লেখা নেই। তবে সিংহভাগ সংগ্রহ কুমার শরৎ কুমার রায় নিজ অর্থ ও জনবলে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, ঢাকা, কুমিল্লা এমনকি বেনারস ও মথুরা থেকেও নিয়ে আসেন। আপাতত তাঁর কথাই মনে করা যেতে পারে।