মায়ের দুধ ছাড়াই বড় হতে হচ্ছে ফাতেমাদের

রাজধানীর আজিমপুরের ছোটমণি নিবাসে ময়মনসিংহে সড়কে জন্ম নেওয়া শিশু ফাতেমা। গত শুক্রবার থেকে এই নিবাসের বাসিন্দা সে
ছবি: প্রথম আলো

ট্রাকচাপায় মায়ের মৃত্যুর সময় সড়কে জন্ম নেওয়া ফাতেমাকে দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। হাসপাতালে আহত ফাতেমাকে বুকের দুধ দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন কয়েকজন মা। তবে সেটা ছিল সাময়িক একটা ব্যবস্থা। হাসপাতাল থেকে ফাতেমা ছুটি পাওয়ার পর মায়ের দুধের ব্যবস্থা করা আর সম্ভব হয়নি।

১৫ দিন বয়সী ফাতেমা এখন রাজধানীর আজিমপুর শিশুমণি নিবাসে। সেখানে ফাতেমার মতো মায়ের দুধ ছাড়াই বড় হচ্ছে অন্য শিশুরা। গত ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ট্রাকচাপায় মারা যান ফাতেমার বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪২), মা রহিমা আক্তার ওরফে রত্না (৩২) ও বোন সানজিদা (৩)।  

একটি শিশুর জন্মের পর চারপাশ থেকে সবচেয়ে জোরেশোরে আওয়াজ আসে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান করানোর বিষয়ে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মায়ের দুধের বিকল্প না থাকার কথা জানিয়ে সতর্কবার্তা, প্রচার, স্লোগানসহ কতশত কার্যক্রম রয়েছে। তবে এসব আয়োজন মায়ের পরশ না পাওয়া পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুর ক্ষেত্রে কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ, তাদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা থাকে না।

আরও পড়ুন

সচেতনতা সৃষ্টিতে এবারও প্রতিবছরের মতো ১ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে। যেসব শিশু মা থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের জন্যও কীভাবে মায়ের দুধের ব্যবস্থা করা যায়, সেটাও আলোচনায় আসা প্রয়োজন। এবার মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মাতৃদুগ্ধ পান এগিয়ে নিতে, শিক্ষা ও সহযোগিতা হবে বাড়াতে’।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ ২০১৭-১৮ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে শিশুর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ পানের হার ৬৫। প্রতিবেদন বলছে, দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে বসবাস করা শিশুদের ওপর ভিত্তি করে এ হিসাব করা হয়েছে।

বেশির ভাগ শিশুই মাকে দেখেনি

সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছোটমণি নিবাসে এখন ফাতেমার মতো নবজাতকসহ ৭ বছর বয়স পর্যন্ত ২৮টি শিশু রয়েছে। এই শিশুদের বেশির ভাগ নবজাতক থেকে দু-এক মাস বয়সে নিবাসে এসেছে। অল্প কিছু রয়েছে কিছুটা বড়, তারা হারিয়ে যাওয়া শিশু।

ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক মোছা. জুবলী বেগম রানু প্রথম আলোকে বলেন, এই শিশুদের বেশির ভাগ জন্মের পর থেকে মা ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ কারণে তারা মায়ের বুকের দুধ পান করার কোনো সুযোগ পায়নি। কৌটার দুধই খাওয়াতে হয়। একটি শিশুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিশুটির মায়ের পরিবার বাবার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছে। শিশুটি এক মাস মায়ের সঙ্গে ছিল।

তখন মায়ের দুধ পান করেছে। আদালতের নির্দেশে শিশুটিকে এক মাস বয়স থেকে ছোটমণি নিবাসের হেফাজতে রাখা হয়। শিশুটির বয়স এখন সাড়ে চার বছর। তবে এখন আর পরিবারের কেউ তাকে নিতে চায় না।

হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সংকটাপন্ন শিশুদের মায়েদের মধ্যে একে অপরের সন্তানের জন্য দুধ দান করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে শিশুমণি নিবাসের শিশুদের জন্য এভাবে কোনো মা কখনো বুকের দুধ দান করেননি বলে জানিয়েছেন জুবলী বেগম।

ফাতেমার দাদা মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ফাতেমাকে প্রথমে যে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করা এক মা তাঁর বুকের দুধ পান করিয়েছিলেন। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দু-তিনজন মা বাটিতে করে বুকের দুধ দিয়ে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি কৌটার দুধ খাওয়ানো হয়েছে।

ফাতেমা যে দোলনায় ছিল, সেখানে আরও তিনটি দোলনায় ছিল এক নবজাতক ও দুটি এক ও দুই মাস বয়সী শিশু। নিবাসের মেট্রন কাম নার্স তানিয়া সুলতানা জানান, এই চার শিশুকে বয়স অনুযায়ী কৌটার দুধ খাওয়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম পত্রিকার তথ্য সংকলন করে জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ফেলে যাওয়া ১০টি নবজাতককে উদ্ধার করা হয়েছে। আর ১৪ নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

কিছু শিশুর প্রাণ বাঁচে সংরক্ষণ করে রাখা মায়ের বুকের দুধে

ব্যক্তিদানে কয়েক বছর ধরে মাতুয়াইলের শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ) হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের মাধ্যমে এক শিশুর জন্য এক মা নীতি এবং প্রত্যেক মা ও শিশুর পরিচয় ডেটাবেইজে রেখে শুধু হাসপাতালে ভর্তি থাকা শিশুদের জন্য মায়ের দুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করছে।

আরও পড়ুন

এই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক এবং হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (এনআইসিইউ) প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন বছরে ফেলে যাওয়া ৪১টি নবজাতককে উদ্ধার করে এই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক থেকে ছয় মাস পর্যন্ত দুধ পান করানো হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি শিশু বেঁচে যায়।

তিনি বলেন, কিছু অপরিণত নবজাতকের নেকরোটাইজিং এন্টারোকোলিটিস (এনইসি) হয়। সে ক্ষেত্রে শিশুর পেট ফুলে যায়, ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়, শিশু একদম মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এ ধরনের শিশুদের একমাত্র মায়ের দুধ পানে করিয়েই বাঁচানো যায়।

মো. মুজিবুর রহমান ওই শিশুদের একটির কথা উল্লেখ করে বলেন, বছরখানেক আগে তিনি ডাস্টবিনের কাছে ফেলে যাওয়া এক নবজাতককে উদ্ধার করে আইসিএমএইচে ভর্তি করেন। শিশুটি ৭৯ দিন হাসপাতালে ছিল, এর মধ্যে এক মাস ছিল লাইফ সাপোর্টে। শিশুটিকে হিউম্যান ব্যাংকে জমা রাখা এক মায়ের দুধ পান করিয়ে বাঁচানো যায়।

ছোটমণি নিবাসে খেলছে শিশুরা
ছবি: প্রথম আলো

জাতীয় পুষ্টি সেবার উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক সুপ্তা চৌধুরী বলেন, শিশুর বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক বিকাশের জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। এর গুরুত্ব বিবেচনায় জাতীয় পুষ্টি সেবা বাস ও রেলস্টেশন, বিভিন্ন বিপণিবিতান, হাসপাতালসহ সব প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার (মায়ের দুধ খাওয়ানোর জায়গা) রাখার পরামর্শ দিচ্ছে বারবার।