প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা পেলেন ৯ জন

‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২’ পাওয়া শিক্ষকদের সঙ্গে ছবি তোলেন অতিথিরা
ছবি: প্রথম আলো

বেঞ্চ-টেবিল দিয়ে সাজানো-গোছানো পরিবেশ। আছে ব্ল্যাকবোর্ড। তাকে সাজানো বিভিন্ন বই। আকস্মিক দেখায় মনে হতে পারে, কোনো বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ও পাঠাগার। সেখানে আসছেন শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িয়ে থাকা মানুষ। কেউ কেউ সেসব বেঞ্চ গিয়ে বসছেন, কেউ আবার এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছেন। এমন অবস্থায় হঠাৎ বেজে উঠল ক্লাস শুরুর সেই চিরচেনা ঘণ্টা। এর পরই শুরু হলো জাতীয় সংগীত।

প্রিয় শিক্ষকদের সম্মাননা জানাতে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। অনুষ্ঠানে সারা দেশের বাছাই করা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯ জন প্রিয় শিক্ষককে দেওয়া হলো ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২’।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে কমবেশি শিক্ষকের অবদান থাকে। সেই শিক্ষকেরা কেবল পড়াশোনাই করান না, তাঁরা শিক্ষার্থীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখান।

আলোকিত করেন অন্তর্লোককে। সেই শিক্ষকদের কথা মনে থাকে সারা জীবন।

দেশজুড়ে থাকা এমন নয়জন অনন্য শিক্ষককে সম্মাননা দেওয়া হলো। সম্মাননা পেয়ে আবেগাপ্লুত হলেন প্রিয় শিক্ষকেরাও। তাই তো সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের একজন চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার মোস্তফা বেগম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জন্নাত আরা বেগম বললেন, ‘শিক্ষকদের সম্মান আছে—এই কথা এত দিন মনে মনে ভাবতাম। এমন অনুষ্ঠানে এসে মনে হলো, সত্যিই শিক্ষকদের সম্মান আছে।’

শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে বেশি কাজ করতে হবে। আর গুণগত শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষক লাগবে। এ জন্য শিক্ষকদেরও সম্মান ও সম্মানী দুটিই দিতে হবে
মমিনুল ইসলাম, আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও

সম্মাননা পাওয়া আরেকজন শিক্ষক বগুড়ার ধুনটের বেলকুচি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোছা. ফৌজিয়া হক বললেন, এটি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

আইপিডিসি ফাইন্যান্স ও প্রথম আলো ২০১৯ সাল থেকে প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা দিয়ে আসছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের দেওয়া হয় এ সম্মাননা। করোনাকালেও থেমে থাকেনি এ আয়োজন।

২০২২ সালের প্রিয় শিক্ষক সম্মাননার বাছাইপ্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল গত বছরের ৫ অক্টোবর। নির্ধারিত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত অনলাইন ও অফলাইনে পাওয়া ১ হাজার ৭৭৯টি মনোনয়নপত্রের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক ২০১ জন এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক ছিলেন ১ হাজার ৫৭৮ জন। তাঁদের মধ্যে থেকে জুরিবোর্ড সবচেয়ে প্রিয় ৯ জন শিক্ষককে সম্মাননার জন্য বাছাই করেন।

শিক্ষকদের সম্মান আছে—এই কথা এত দিন মনে মনে ভাবতাম। এমন অনুষ্ঠানে এসে মনে হলো, সত্যিই শিক্ষকদের সম্মান আছে
জন্নাত আরা বেগম, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক

এবার সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকেরা হলেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দ্বীপেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার মোস্তফা বেগম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক জন্নাত আরা বেগম, কক্সবাজারের ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নূরুল ইসলাম, বগুড়ার ধুনটের বেলকুচি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. ফৌজিয়া হক, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর তালুক জামিরা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. জহুরুল হক চৌধুরী, লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. তউহিদুল ইসলাম সরকার, রাজশাহীর পুঠিয়ার ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন, মৌলভীবাজারের বড়লেখার দাসের বাজার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস ও দিনাজপুরের ঈদগাহ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফজলুর রহমান। অনুষ্ঠানে তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন।

এসব গুণী শিক্ষকের হাতে সম্মাননা হিসেবে দেওয়া হলো ক্রেস্ট, উত্তরীয়, সনদ। এ ছাড়া প্রত্যেককে দেওয়া হয় দুই লাখ টাকার চেক।

প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের হাতে সম্মাননা তুলে দিচ্ছেন অতিথিরা।

পরিবর্তন অনেক, জোর হোক শিক্ষার মানে

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনিও দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর বক্তব্যেও উঠে এল সেসব কথা। শামসুল আলম বলেন, শিক্ষায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন উদ্বিগ্ন মান নিয়ে। তিনি বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

প্রিয় শিক্ষকদের হাতে সম্মাননা তুলে দিতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী সম্মাননা পাওয়া শিক্ষকদের অভিবাদন জানান।

এবার ১ হাজার ৭৭৯টি মনোনয়নপত্রের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক ২০১ জন এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক ছিলেন ১ হাজার ৫৭৮ জন। তাঁদের মধ্যে থেকে জুরিবোর্ড সবচেয়ে প্রিয় ৯ জন শিক্ষককে সম্মাননার জন্য বাছাই করেন।

স্বাগত বক্তব্যে আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে আরও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে বেশি কাজ করতে হবে। আর গুণগত শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষক লাগবে। এ জন্য শিক্ষকদেরও সম্মান ও সম্মানী দুটিই দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে নিজেদের প্রিয় শিক্ষকের পাশাপাশি শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক  মোহাম্মদ কায়কোবাদ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আতিকুল ইসলাম, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য এম এম শহীদুল হাসান, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এইচ এম জহিরুল হক, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মো. আবুল কাশেম মিয়া প্রমুখ।

দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা।

এম এম শহীদুল হাসান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জুরিবোর্ডের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর, খুলনার ব্রজলাল কলেজের পদার্থের অধ্যাপক সমীর কুমার দেব, আজিমপুর গভ. গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যাপক গীতাঞ্জলি বড়ুয়া ও বগুড়ার শেরপুরের উপজেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ পারভীন।

সমাপনী বক্তৃতায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, যেসব শিক্ষককে সম্মাননা দেওয়া হলো, তাঁরা প্রত্যেকে শুধু সেরা শিক্ষকই নন, সেরা মানুষও। তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামনে নিতে অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেন। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সফলতাগুলোকে প্রথম আলো মনে রাখে ও স্বীকৃতি দেয়। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময়ই বলি, আমাদের একটাই লক্ষ্য, আমরা বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে জয় দেখতে চাই, সফলতা দেখতে চাই।’

আরও পড়ুন

অনুষ্ঠানে আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পথচলার গল্পটি ঐতিহ্যবাহী পুঁথির সুরে তুলে ধরেন সাজেদ ফাতেমীর ব্যান্ড দল নকশীকাঁথা। এ ছাড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নৃত্যের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। পরিবেশনায় ছিলেন সামিউল ইসলাম ও আশনা হাবিব ভাবনা। এ ছাড়া ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা...’ গানটি গেয়ে শোনান সংগীতশিল্পী মুহিন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে শিক্ষকদের বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে অভিবাদন জানান উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যান্ডদল ও স্কাউটসের একটি চৌকস দল। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনায় ছিলেন প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান মুনির হাসান ও প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। শিক্ষার্থী সেজে বিদ্যালয়ের পোশাক পরে উপস্থাপনা করেন তাঁরা।

বিদ্যালয়ের মতো ঘণ্টা বাজিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানটি শেষও হয় ঘণ্টা বাজিয়ে, যেন বিদ্যালয়ের ছুটির ঘণ্টা বাজল।