রানা প্লাজার সেই রেশমার প্রশ্ন, ‘নিজে ইচ্ছা করে কেন মৃত্যুকূপে ঢুকব?’

রাজধানীর ভাটারা এলাকার ভাড়া বাসায় রেশমা আক্তারছবি: প্রথম আলো

ঢাকার উপকণ্ঠে সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ২০১৩ সালের ১০ মে বিকেলে জীবিত, অক্ষত অবস্থায় রেশমা আক্তারকে উদ্ধার করেছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। রানা প্লাজা ধসের ১৭তম দিনে তাঁকে উদ্ধারের ঘটনাটি তখন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে আলোচিত হয়। রেশমা উদ্ধারের ১১ বছর পূর্ণ হলো আজ। এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রেশমা বলেন, এত বছর পরও মানুষের বাজে মন্তব্য থামেনি। যাঁরা বাজে মন্তব্য করেন, তাঁদের প্রতি তাঁর প্রশ্ন, ‘নিজে ইচ্ছা করে কেন মৃত্যুকূপে ঢুকব?’

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ১৩৫ জন। দুই হাজারের বেশি শ্রমিক আহত হন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ভাটারা এলাকার ভাড়া বাসায় রেশমার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ভাবিনি আর কোনো দিন পৃথিবীর আলো দেখতে পাব। সেই স্মৃতি ভুলতে পারি না। অনেকেই বলে, আমি নাকি সেখানে আটকে পড়িনি, সরকার আমাকে সেখানে ঢুকিয়েছিল। অনেকেই বলে, এত মানুষ মরে গেল, আমি বাঁচলাম কীভাবে? অনেকের হাত-পা কেটে গেছে। আমার কেন হাত–পা কাটেনি? আমি মরে গেলে বা আমার হাত-পা কেটে গেলে মানুষ খুশি হতো? নিজে ইচ্ছা করে কেন মৃত্যুকূপে ঢুকব?’

মানুষের বাজে মন্তব্য থেকে বাঁচতে এখন নিজের পরিচয় গোপন করেন বলে জানান রেশমা। যাচাই–বাছাই না করে বাজে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

ভাড়া বাসায় স্বামী আতাউর রহমানের সঙ্গে থাকেন রেশমা। তাঁদের আট বছর বয়সী মেয়ে রেদোয়ানা ইসলাম কাছের এলাকার দাদির সঙ্গে থাকে। সে পড়ছে একটি মাদ্রাসায়।

রেশমা বর্তমানে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল দ্য ওয়েস্টিনে পাবলিক এরিয়া অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কর্মরত। উদ্ধার হওয়ার পর ২০১৩ সালের ৬ জুন তাঁকে চাকরি দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ।

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া নিয়ে ইউটিউবে থাকা তখনকার ভিডিও দেখছেন রেশমা
ছবি: প্রথম আলো

সব মিলিয়ে কেমন আছেন? জানতে চাইলে রেশমা হেসে বলেন, এখন তিনি ভালোই আছেন। তবে বিভিন্ন ভিডিও, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে মানুষের বাজে মন্তব্য তাঁকে কষ্ট দেয়। তিনি জীবিত উদ্ধার হয়েছেন, এটা যদি কেউ বিশ্বাস না করেন, তবে তাঁর করার কিছু নেই।

রেশমা বলেন, উদ্ধারের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যম তাঁকে নিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অনেকেই বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে তিনি বাড়ি, গাড়িসহ অনেক কিছু পেয়েছেন। রেশমার প্রশ্ন, তাহলে তো তাঁর আরও ভালো অবস্থানে থাকার কথা ছিল।

রেশমা জানান, উদ্ধারের পর তাঁর মায়ের হাতে প্রধানমন্ত্রী ৫০ হাজার টাকার চেক দিয়েছিলেন। আর কারখানার পক্ষ থেকে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে রেশমার একাধিক বিয়ের খবরও প্রকাশিত হয়। সে প্রসঙ্গে রেশমা বলেন, ‘ওই যে বললাম, যে যাঁর মতো করে প্রতিবেদন করেছেন। এগুলো সত্য নয়। আমাকে নিয়ে নাটক সাজানোর কথাও সত্য নয়।’

রেশমা বলেন, ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি রানা প্লাজার তিনতলার একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ১০ মে তিনি উদ্ধার হন।

সেনা ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রেশমা উদ্ধার হয়েছিলেন। তাঁকে জীবিত উদ্ধার করার ঘটনাকে ‘আনন্দময় অর্জন’ বলে তখন উল্লেখ করেছিলেন উদ্ধারকর্মীরা।

উদ্ধারের সময় রেশমার পরনের নতুন পোশাক, তাঁর অক্ষত থাকাসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তখন উদ্ধারকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রেশমার কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছিল। যেখানে তিনি আটকা পড়েছিলেন, সেখানে একটি কাপড়ের দোকান ছিল। উদ্ধারের আগে ওই দোকান থেকে কাপড় সংগ্রহ করে তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয়।

রেশমা আক্তার জানিয়েছেন, তিনি এখন ভালো আছেন। তবে মানুষের বাজে মন্তব্য নিয়ে কষ্ট পান তিনি
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল রেশমা বলেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ার পর তাঁর গায়ের জামা-কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছিল। উদ্ধারের আগে সেখানে থাকা একটি প্যাকেট থেকে নতুন পোশাক গায়ে জড়িয়েই তিনি বের হয়েছিলেন। তাঁর হাত-পায়ের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গিয়েছিল। তিনি সেখানে কত দিন আটকে ছিলেন, তা–ও তখন বুঝতে পারেননি। ঘুম ঘুম ভাব বা বেশির ভাগ সময় তিনি অচেতন ছিলেন। তিনি যেখানে আটকে পড়েছিলেন, সেখানে পানি ছিল। কিছু শুকনো খাবারও ছিল। তা খেয়েছেন কয়েক দিন। একসময় হাতড়ে একটি পাইপ পেয়েছিলেন। ছোট একটি ছিদ্র দিয়ে পাইপটি ঢুকিয়ে বাইরে থাকা উদ্ধারকর্মীদের তিনি জানান দিয়েছিলেন যে তিনি বেঁচে আছেন।

রেশমাকে উদ্ধারের পর সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ঘটনার পর উদ্ধারকর্মীদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।

উদ্ধারের পরের ঘটনা মনে আছে কি না, জানতে চাইলে রেশমা বলেন, সবকিছু তাঁর মনে নেই। তবে কেউ একজন বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে মুঠোফোন কথা বলবেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে তাঁর কথা হয়। হাসপাতালে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।

ভবনধসের আগের পরিস্থিতি সম্পর্কে রেশমা বলেন, শ্রমিকেরা সবাই কাজ করছিলেন। ভবনে ফাটলসহ নানা ঘটনায় কেন কর্মীদের ছুটি দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে কেউ কেউ চিল্লাপাল্লাও করছিলেন। পরে হাতমাইকে ছুটির ঘোষণা শুনেছিলেন তিনি। কর্মীরা বের হচ্ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, একটু ফাঁকা হলেই বের হবেন। তারপর তাঁর মাথায় কিছু একটা পড়েছিল নাকি অন্য কিছু হয়েছিল, সেসবের কিছু তাঁর আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, তিনি যেখানে আটকে পড়েছিলেন, সেখানে অন্ধকার ছিল। একজন মানুষ শুয়ে থাকতে পারে, এমন ফাঁকা জায়গা ছিল। আশপাশের কেউ কেউ ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিলেন। কেউ কেউ পানি চাচ্ছিলেন। তারপর একসময় সব থেমে গেলে তিনি বুঝতে পারেন যে আশপাশে থাকা মানুষগুলো মারা গেছেন। তাঁর চুলে ময়লায় জটা লেগে গিয়েছিল। সেখানে পাওয়া একটি কাঁচি দিয়ে তিনি নিজেই নিজের মাথার চুল ছোট করে কেটে ফেলেছিলেন।

রেশমাকে উদ্ধারের পর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সেনাসদস্য আবদুর রাজ্জাক প্রথম তাঁর (রেশমা) উপস্থিতি জানতে পেরেছিলেন।

পরে আবদুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে রেশমা ভবনের দ্বিতীয় তলায় আটকে ছিলেন। সেখানে অনেক ঘন ঘন পিলার থাকায় পুরোটা ধসে পড়েনি। কিছু ফাঁকা জায়গা ছিল। এ কারণেই সেখানে রেশমা এত দিন টিকে থাকতে পেরেছিলেন।

ধ্বংসস্তূপের নিচে রেশমার উপস্থিতি জানার পর উদ্ধারকারীরা সেখানে সব ধরনের ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। হাতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দিয়ে তাঁরা তাঁকে ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে বের করে আনেন।

২০১৩ সালের জুনে যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড সানডে মিরর পত্রিকায় সাইমন রাইটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাককর্মী রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনাটি ছিল সাজানো নাটক। প্রতিবেদনটিকে মনগড়া বলে নাকচ করেছিল আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। আইএসপিআর বলেছিল, সিএমএইচে চিকিৎসা শেষে ৬ জুন রেশমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তেও তিনি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁকে বিভিন্ন সংস্থা চাকরির প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে ওয়েস্টিনের প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেন। সাভার সিএমএইচ থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সেখানে যোগ দেন।

রাজধানীর পাঁচ তারকা একটি হোটেলে পাবলিক এরিয়া অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কর্মরত রেশমা
ছবি: প্রথম আলো

ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে রেশমাকে চাকরি দেওয়ার খবর সবাইকে জানিয়েছিল। সেই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রেশমা বলেছিলেন, ‘আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে তো আপনারা ছিলেন না। কাজেই আপনাদের কোনো ধারণা নেই।’

রেশমা–উদ্ধার বিতর্ক নিয়ে জাতীয় সংসদেও হইচই হয়। এ ঘটনাকে ‘সাজানো নাটক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন তখনকার বিরোধী দল বিএনপির সংসদ সদস্য শহীদউদ্দিন চৌধুরী অ্যানী। তিনি এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছিলেন।

গতকাল রেশমা বলেন, তাঁকে নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সরাসরি বা অনলাইনে বাজে মন্তব্যকারীদের মুখ তিনি বন্ধ করতে পারবেন না। তবে সরকার তথ্যপ্রমাণ দিয়ে এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারে।

রেশমার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলায়। রেশমা যখন একদম ছোট, তখন তাঁর বাবা আনসার আলী মারা যান। মা জোবেদা খাতুন পরে আবার বিয়ে করেন। রেশমার দুই ভাই ও দুই বোন আছে। রেশমা সবার ছোট। রেশমা বলেন, সরকারের কাছে থেকে তিনি বাড়ি-গাড়ি কিছু পাননি। তিনি নিজে যেহেতু সুস্থ আছেন, কাজ করতে পারছেন, তাই তিনি সরকারের কাছ থেকে কিছু চানও না। একমাত্র মেয়েকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।