সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যক্রমের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে বড় পদক্ষেপ নিতে হবে

নবগঠিত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যালয় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অতিথিরা। ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ছবি: সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সৌজন্যে

নবগঠিত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যালয় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় যে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটা হচ্ছে এই সচিবালয়ের যে কার্যক্রম, এটার স্থায়িত্ব বজায় রাখা। সামনের মাস ও বছরগুলো বলে দেবে, সেটা আমরা কত সাফল্যের সঙ্গে অর্জন করতে পারব।’

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যালয় উদ্বোধনের পর প্রধান বিচারপতি আজ বৃহস্পতিবার এ কথা বলেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ভবন-৪-এর (সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদসংলগ্ন) দ্বিতীয় তলার দুটি কক্ষে আপাতত সচিবালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আজ বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একটা ঐতিহাসিক দিন। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের স্বতন্ত্র সচিবালয় স্থাপন করা হলো।

এর আগে গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ (সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫) জারি করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে অধস্তন আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সব প্রশাসনিক ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে এই সচিবালয়।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিচারকাজে নিয়োজিত বিচারকদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ও ছুটিবিষয়ক সব সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় এই সচিবালয়ের হাতে থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সচিবালয়ের সচিব প্রশাসনিক প্রধান হবেন।

এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ

অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আজ আমরা প্রকৃত অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আমাদের নিজেদের আমরা পাচ্ছি।... এই অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতায় এবং স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) হিসেবে কিন্তু কালেক্টিভভাবে (সমষ্টিগত) এই সচিবালয় আমাদের প্রাপ্তি হয়েছে।’

এ সময় সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘এটার সাফল্য আমাদের যতটা অর্জন হবে, এটার ব্যর্থতাও কিন্তু আমাদেরকে মেনে নিতে হবে। সেই দিক থেকে সবার কাছে আমার আহ্বান রইল—আগামী দিনে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তাদের তো বটেই এবং আমাদের যত স্টেকহোল্ডার (অংশীজন) আছে, তাদের সবাইকে এই ধারাবাহিকতা, এই সচিবালয়ের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন বজায় রাখা, গণতন্ত্রকে বজায় রাখা—এই ধারাবাহিকতা যেন অটল থাকে, অটুট থাকে।’

এ সময় গণমাধ্যমের উদ্দেশে সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আমি সব সময় বলি আপনারা ফোর্থ স্টেট (চতুর্থ স্তম্ভ)। যারা মিডিয়া আছেন, আপনারা প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়া আছেন; আপনারা গত ১৬ মাসে আমাদের যে সহযোগিতা দিয়েছেন, সারা দেশে আমাদের যে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, সে জন্য আমি আপনাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। আপনাদের ছাড়া এটা করতে পারতাম না। সামনের এই যাত্রায় আশা করি আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন।’

আজকের এই শুভসূচনার বিষয়টি তুলে ধরে সৈয়দ রেফাত আহমেদ আরও বলেন, ‘দেখবেন, আমাদের কার্যক্রম এরপর প্রতিদিন কিছু না কিছু হচ্ছে। দুটি কমিটি (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং পদ সৃজন কমিটি) ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে। এই কার্যক্রম এখন প্রতিদিন প্রক্রিয়াধীন থাকল।’

আর রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না: আইন উপদেষ্টা

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইন করার জন্য বিগত দুই থেকে তিন দশক ধরে বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা হয়েছে উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘এর আগে করা সম্ভব হয়নি। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এই আইন (সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫) পাস হয়েছে। এর পেছনে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রথম থেকেই অত্যন্ত উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের এনকারেজ (উৎসাহ) করেছেন, গাইড করেছেন (পরামর্শ দিয়েছেন)।’

এখন এটি প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের মানুষের লাভ কী—এমন প্রশ্ন তুলে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘লাভটা হচ্ছে, আপনারা আগে সব সময় শুনতেন যে অধস্তন আদালত যে আছে, ট্রায়াল কোর্ট আছে, সেগুলোর ওপর যে রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীরা ছিল, বিশেষ করে আইনমন্ত্রীর কথা বেশি শোনা যেত। ওনারা অনেক ধরনের খবরদারিত্ব করতেন—কে জামিন পাবে, কে জামিন পাবে না, কী রায় হবে, কীভাবে রায় হবে না—এ সমস্ত কিছু; কোন মামলাটা আগে শুনানি হবে, কোন মামলা হবে না, বিচারকদের পোস্টিং, পদোন্নতি, বদলি—এই সমস্ত কিছু রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এখন আর এ রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না।’

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘এটা আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে যে প্রধান বিচারপতি আছেন, ওনার নেতৃত্বে যে সচিবালয় আছে, সেখানে ন্যস্ত করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী দিনে এই সচিবালয় বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে। এটা ছাড়াও এই সচিবালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট আর্থিক স্বাধীনতা পেয়েছে।’

এ সময় আপিল বিভাগের বিচারপতিরা, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।