অর্থসংকটে শিক্ষার্থীদের পাশে ‘দান নয়, ধার’

২০২০ সালের এপ্রিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে ‘দান নয়, ধার’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
ছবি: সংগৃহীত

শুরুটা হয়েছিল করোনা মহামারিকালে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী আকস্মিক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন। তাঁদের সহযোগিতার জন্য কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিলে একটি তহবিল গঠন করেন। এ তহবিল থেকে সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টাকা ধার দেওয়া হয়।

এভাবেই ২০২০ সালের ২৪ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে কার্যক্রম শুরু করে ‘দান নয়, ধার’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বর্তমানে তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যই কাজ করছে।

সংগঠনটি জানায়, অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের জামানত বা জামিনদার (গ্যারান্টার) ছাড়াই তারা টাকা ধার দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা ১০০ শিক্ষার্থীকে মোট ১০ লাখ টাকা ধার দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ধারের টাকা ফেরত পাওয়ার হার প্রায় শতভাগ। বর্তমানে সংগঠনের তহবিলে ৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা আছে।

‘দান নয়, ধার’ নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মো. রকিবুল হোসেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। রকিবুল সেন্টার ফর কোয়ালিটি সলিউশন (সিকিউএস) নামের একটি বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী।

ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগটির বিষয়ে রকিবুল প্রথম আলোকে বলেন, দেশে করোনা হানা দিলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী টিউশনি হারান। তাঁরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন। তখন আবার অনলাইনে ক্লাস চালু হওয়ায় স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ কেনার জন্য কোনো কোনো শিক্ষার্থীর টাকার প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনের কথা ভেবেই ধারণাটি মাথায় আসে। তিনি ভেবেছেন, দান হিসেবে অর্থ গ্রহণ করা কারও জন্য বিব্রতকর হয়। তবে ধার হিসেবে অর্থ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিব্রত হওয়ার সুযোগ কম।

এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে তিনি উদ্যোগটি নেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের দেওয়া ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা দিয়ে উদ্যোগটির যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের টাকা ধার দেওয়া হয়। গত জুন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদেরও টাকা ধার দেওয়া হচ্ছে।

রকিবুল জানান, উদ্যোগের কার্যক্রম প্রসারিত, সহজ ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে চলতি বছরের জুনে একটি ওয়েবসাইট (www.dannoy-dhar.org) চালু করা হয়। বর্তমান শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোন ও ল্যাপটপ কেনার জন্য সংগঠন থেকে টাকা ধার নেন। কেউ সাইকেল কেনার জন্য টাকা ধার চান। ইংরেজি কোর্স করতেও কেউ টাকা নেন। এ ছাড়া টিউশনি না থাকায় পড়াশোনার খরচ চালাতে টাকা নিয়েছেন কেউ কেউ। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির বই কেনা বা চাকরির আবেদন ফরম পূরণের জন্যও টাকা ধার নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সংগঠনটি জানায়, সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা ধার দেয়। শিক্ষার্থীদের মোট ৬টি কিস্তিতে এই টাকা ফেরত দিতে হয়।

আবদুল্লাহ বিন জাফর নামের এক শিক্ষার্থী করোনাকালে অনলাইন ক্লাস করার জন্য স্মার্টফোন কিনতে এ সংগঠন থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। এ নিয়ে তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘সামান্য কিছু তথ্য দেওয়ার পর আমাকে টাকা ধার দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে এই ফান্ডে আমিও একজন দাতা অংশগ্রহণকারী হতে পারলে খুশি হব।’

সাকিব জামান নামের আরেক শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, হঠাৎ তাঁর কম্পিউটারের মনিটর নষ্ট হয়ে যায়। তখন তাঁর হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না বলে ধার করতে হয়। সংগঠনটি আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

জামানত ছাড়াই অর্থনৈতিক প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা টাকা ধার পাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ১০০ শিক্ষার্থীকে ১০ লাখ টাকা ধার দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সংগঠনটির উদ্যোক্তারা বলছেন, কার্যক্রমের শুরুতে মূল আশঙ্কা ছিল, শিক্ষার্থীরা ধার নেওয়া টাকা ঠিকঠাক ফেরত দেবেন কি না। তবে এই আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ধারের প্রায় শতভাগ টাকা ফেরত এসেছে।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখন কেউ টাকা ধার নিতে চাইলে তাঁকে ওয়েবসাইটে থাকা ফরমে আবেদন করতে হয়। আবেদনকারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ তাঁর বিষয়ে খোঁজখবর নেয় সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। সংগঠনে বর্তমানে এমন ১৬ জন স্বেচ্ছাসেবক আছেন। সব শর্ত পূরণ হলে শিক্ষার্থীকে তারা টাকা ধার দেয়।

তহবিলের স্বচ্ছতা বজায় রাখাসহ যেকোনো বিতর্ক এড়ানোর দিকটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানান সংগঠনটির উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলেন, যাঁরা তহবিলে টাকা দেন, তাঁদের নামসহ ছবি ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। টাকা ধার দেওয়া, ফেরত পাওয়া, বকেয়া—সবকিছুর হিসাব ওয়েবসাইটে রয়েছে। যাঁরা সংগঠনের তহবিলে টাকা দেন (দাতা), তাঁরা চাইলে যেকোনো সময় তা ফিরিয়ে নিতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ থাকার শর্ত আছে।

এখন পর্যন্ত টাকা ধারের এই তহবিলে মোট ৩৯ জন সহায়তা দিয়ে অবদান রেখেছেন। তাঁদের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাইফুল মালিক। তিনি তাঁর নিজ জেলার শিক্ষার্থীদের ধার দেওয়ার জন্য তহবিলে এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। সাইফুল বলেন, এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তিনি গর্বিত।

উদ্যোক্তারা জানান, তাঁরা আগামী বছরের শুরুতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি মেডিকেল কলেজে এ কার্যক্রম শুরু করতে চান। সংগঠনটিকে একটি আনুষ্ঠানিক ফাউন্ডেশনে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাঁদের। তাঁরা ভবিষ্যতে সারা দেশে কার্যক্রম চালাতে চান। পাশাপাশি তাঁরা শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ারভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ আয়োজনেরও পরিকল্পনা করছেন।

তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, তহবিলের সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁরা বেশি শিক্ষার্থীকে টাকা ধার দিতে পারেন না। তহবিল বাড়ানো গেলে আরও বেশি শিক্ষার্থীকে টাকা ধার দেওয়া, ধারের অর্থের পরিমাণ বাড়ানো ও অর্থ ফেরত দেওয়ার সময় বাড়ানো সম্ভব হবে।

‘দান নয়, ধার’ সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও বিকাশে অনেক ধরনের সংগঠন, ক্লাব বা কার্যক্রম আছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আর্থিক প্রয়োজন নিয়ে কাজ করে—এমন সংগঠন বিরল। এদিক দিয়ে ‘দান নয়, ধার’ ব্যতিক্রম। শিক্ষার্থীদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে দান না করে টাকা ধার দিয়ে তাঁদের প্রয়োজনে কাজ করাটা সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ এক উদ্যোগ। তা ছাড়া এই কার্যক্রম প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবেও কাজ করছে।