নৃত্যগুরু আমানুল হকের নির্দেশনায় ১৯৬৮ সালে ‘সোনাঝরা সন্ধ্যা’ প্রযোজনায় নাচ করেন গোলাম মোস্তফা খান। সামাজিক পটভূমিতে সেই নৃত্যে অনবদ্য পরিবেশনা ছিল তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের পর বিটিভির জন্য ‘কিষানির স্বপ্ন’ ও ‘বাঁশরিয়া’ নামে দুটি নৃত্য প্রযোজনা করেন আমানুল হক। সেখানেও মূল চরিত্রে ছিলেন গোলাম মোস্তফা খান। তাঁর শেষবিদায়ের আয়োজনে সেই দিনগুলো স্মরণ করে বিষণ্ন আমানুল হক।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় শেষশ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির সংগীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তি ভবনের আঙিনায় আনা হয় একুশে পদকপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী গোলাম মোস্তফা খানের মরদেহ। সেখানে ছিলেন শোকাহত শিল্পীরা। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় এই নৃত্যগুরুকে শেষবিদায় জানান তাঁরা।
এ সময় আমানুল হক বলেন, ‘গোলাম মোস্তফা খানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৬ সালে। বেশি দিন তিনি পারফর্ম করেননি। বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে নৃত্যচর্চার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শত ব্যস্ততার মাঝে নৃত্যশিল্পীদের জন্য বই লিখেছেন। তাঁর অবদান ভোলার নয়।’
বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও ছায়ানটের শিক্ষক শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সমাজে নৃত্যের মাধ্যমে কীভাবে সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে দেওয়া যায়, গোলাম মোস্তফা খান আমাদের সেটা দেখিয়ে গেছেন। আমি বলি, তিনি স্বশিক্ষিত শিল্পী ছিলেন। তাঁর কাজ ও আদর্শকে বয়ে নিয়ে যাওয়াই হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাজ।’
বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার আয়োজনে এই শিল্পীকে শেষশ্রদ্ধা নিবেদন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক, সাধারণ সম্পাদক এস কে মাহফুজুর রহমান, নৃত্যশিল্পী নিগার চৌধুরী, বেলায়েত হোসেন খান, মুনমুন আহমেদ, সাদিয়া ইসলাম মৌ, ফারজানা চৌধুরী বেবী, সেলিনা হক, সাজু আহমেদ, কাজল ইব্রাহীম, সামিনা হোসেন প্রেমা, এম আর ওয়াসেক, আনিসুল ইসলাম হিরু প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান চেয়ারপারসন মনিরা পারভীন, তামান্না রহমান, দীপা সরকার, ওয়ার্দা রিহাব ও র্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নৃত্যচর্চাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। আমরা যখন সাংস্কৃতিক জাগরণের কথা বলি, নারী-পুরুষের সমতার কথা বলি, তখন গোলাম মোস্তফা খান সংস্কৃতির শক্তিতে মেলবন্ধন রচনা করে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক পরিচালক গোলাম মোস্তফা খানের তিন মেয়ে ইমন মোস্তফা, শাওন মোস্তফা ও মিতা মোস্তফা। বাবার শেষশ্রদ্ধার আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমিতে এসেছিলেন তাঁরাও। ছোট মেয়ে মিতা মোস্তফা বলেন, ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র ছিল বাবার চতুর্থ কন্যা। আমরাও বলতাম, আমরা আসলে চার বোন। বাবা সারা জীবন সংস্কৃতি সাধনা করে গেছেন। আমাদেরও সে পথেই আলোকিত করেছেন।’
বাদ জোহর শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথম জানাজার পর গোলাম মোস্তফা খানের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় লালমাটিয়ার বাসভবনে। সেখানে গোসলের পর লালমাটিয়া সি ব্লক জামে মসজিদে বাদ জোহর দ্বিতীয় জানাজার পর আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয় এই শিল্পীকে।
নৃত্যগুরু গোলাম মোস্তফা খান গত রোববার রাত ৮টা ১৫ মিনিটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি নিউমোনিয়াসহ শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
গোলাম মোস্তফা খান ১৯৪০ সালের ২৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত লোকনৃত্য ও নজরুল নৃত্য করতেন। বেশ কিছু নৃত্যনাট্যেও কাজ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন বহু নৃত্যশিল্পী। বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন গোলাম মোস্তফা খান। সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৭ সালে পেয়েছেন শিল্পকলা পদক। ২০২০ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে সরকার।