বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতরাই বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ঢাকা, ২৩ জানুয়ারিছবি: দীপু মালাকার

গণ-অভ্যুত্থানের নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের দাবি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিরাই এখন সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নিহত ব্যক্তিদের রক্তের বিনিময়ে কেউ কেউ পদ পেয়েছেন, গদি পেয়েছেন, উপদেষ্টা হয়েছেন। কিন্তু শহীদদের প্রাপ্য সম্মানের জন্যও তাঁদের স্বজনদের এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে।

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আজ বৃহস্পতিবার সকালে এক মানববন্ধনে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা এ কথাগুলো বলেন। ‘জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত সকল শহীদ পরিবার’ এই মানববন্ধনের আয়োজন করে। মানববন্ধনে ৯ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।

মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে নিহত মাসুদ রানার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস মানববন্ধনে অভিযোগ করেন, এখন সরকার, সমন্বয়ক, উপদেষ্টা—কেউই শহীদ পরিবারের স্বজনদের কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না। অথচ নিহতদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়েই তাঁরা পদ পেয়েছেন, গদি পেয়েছেন, উপদেষ্টা হয়েছেন। আর আন্দোলনে যাঁরা নিহত হলেন, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে এ সরকার গঠিত হলো, সেই নিহতের স্বজনেরা পেলেন রাস্তা। তাঁর অভিযোগ, এখন তাঁদের রাস্তায় রাস্তায় নিহত ব্যক্তিদের অধিকারের জন্য ঘুরতে হচ্ছে।

আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই রামপুরায় নিহত রাসেল মিয়ার স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে গেলে আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলা হয় যে আমরা দান-ভিক্ষার জন্য গেছি। আমরা কেন ভিক্ষা নেব? আপনারা আমাদের সম্মানস্বরূপ অর্থ প্রদান করবেন। আমরা কারও কাছে দান-ভিক্ষা চাইনি।’

যাত্রাবাড়ীর পকেট গেট এলাকায় ১৮ জুলাই নিহত সাকিব হাসানের বাবা মর্তুজা আলম বলেন, ‘আমার সন্তানসহ আন্দোলনে আরও যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, সবার হত্যার বিচার চাই। এ সরকার দ্রুত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করুক। আর শহীদদের প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি।’

মোহাম্মদপুরে নিহত ইমনের মা বলেন, ‘যে স্বৈরাচার সরকার আমার মতো মা-বাবার বুক খালি করেছে, তার যেন ফাঁসি হয়। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, যে রাজকীয় ব্যবস্থায় তাঁরা আছেন, টিভিতে খবরে তাঁদের চেহারা দেখলে আর ভালো থাকতে পারি না। আমাদের সন্তানদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের দায়িত্ব ছিল সন্তান হত্যার বিচার করা। কিন্তু সরকারের সিংহাসন পর্যন্ত আমাদের কান্না পৌঁছাচ্ছে না।’

মানববন্ধনে অন্য শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে শুধু সরকার পরিবর্তন, আমলা পরিবর্তন হয়েছে। আর কোনো কিছুরই কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোনো সিস্টেমের পরিবর্তন হয়নি। যদি পরিবর্তন হতো তাহলে শহীদ পরিবারের সদস্যদের অসম্মানিত হয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন, মানববন্ধন করতে হতো না।

শহীদ পরিবারের সদস্যদের পক্ষে তাঁদের ৯ দফা দাবি ঘোষণা করেন আন্দোলনে ঢাকায় নিহত-আহতদের তালিকা তৈরির কাজে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকা তামিম খান। দাবিগুলো হচ্ছে, হত্যার সঙ্গে জড়িত সবার দ্রুত বিচার করা; পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে শহীদ পরিবারের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা; অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তাঁদের স্মরণে দিবস ঘোষণা; শহীদ পরিবারের জন্য কর্মসংস্থান ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা; শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঞ্চয়পত্রের বদলে এককালীন নগদ অর্থ দেওয়া; শহীদদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও স্মৃতিফলক নির্মাণ; বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষায় শহীদ পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট কার্ড প্রদান; শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য উপদেষ্টা নিয়োগ এবং শহীদ পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি
ছবি: দীপু মালাকার

তামিম খান বলেন, দেশের পরিস্থিতি পাল্টাল, সরকার বদলাল, কিন্তু যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই দেশ, তাঁরাই সবচেয়ে বড় বৈষম্যের শিকার। শহীদ পরিবারের সদস্যরা না পাচ্ছেন ঠিকমতো সুযোগ-সুবিধা, না তাঁদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। আহতরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। তাঁদের যে অনুদান দেওয়ার কথা, সেটাও পাচ্ছেন না।

মানববন্ধনে আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের অর্ধশতাধিক স্বজন উপস্থিত ছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের ছোট সন্তানেরাও মানববন্ধনে ছিল। এ সময় জানানো হয়, ঢাকা জেলায় এখন পর্যন্ত ৩১৪ জন শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা ৯৪ জন। আহত হয়েছেন ২৯ হাজার। কিন্তু ভেরিফায়েড (যাচাই-বাছাই) তালিকায় সেই সংখ্যা খুব কম।

মানববন্ধনে স্বজনদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

এদিকে মানববন্ধন করার জায়গা নির্দিষ্ট করা নিয়ে মতভেদে স্বজনেরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কর্মসূচি পালন করেন। একদল প্রেসক্লাবের মূল ফটক (মূল সড়কের দিকে যেটি বন্ধ থাকে) সংলগ্ন মেট্রো স্টেশনের নিচে মানববন্ধন করে। অপর দলটি প্রেসক্লাবের পশ্চিম পাশের ফটক (পুলিশ বক্স–সংলগ্ন) সংলগ্ন স্থানে মানববন্ধন করে।