ভোটের দিনেও চাচা-ভাতিজার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আছমত আলী খান পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোট কেন্দ্রে ভোটারেরা। সকাল সাড়ে দশটায় তোলা ছবি। মাদারীপুর, ৮মেছবি: সাজিদ হোসেন

ভোররাত থেকে ঝুম বৃষ্টি। সকালেও আকাশ মেঘলা। সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু হলেও ভোটকেন্দ্র প্রায় ভোটারশূন্য। রাস্তাঘাটও ছিল বেশ ফাঁকা। তবে পরে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বাড়ে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে তিনটি কেন্দ্রে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও হট্টগোল ছাড়া অনেকটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আজ বুধবার মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হয়।

মাদারীপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী চাচা-ভাতিজা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান আনারস প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য। তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পাভেলুর রহমান খান (মোটরসাইকেল)। তিনি শাজাহান খানের চাচাতো ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী পরস্পরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো ও ভোট কিনতে টাকা বিলির অভিযোগ করেন। চেয়ারম্যান প্রার্থী ছেলের পক্ষে কৌশলে ও গোপনে প্রচারের কাজ করেন বলে অভিযোগ ওঠে স্থানীয় সংসদ সদস্য শাজাহান খানের বিরুদ্ধে। তবে অভিযোগ জানালেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ভোটারদের মনে ভোট নিয়ে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তা নিয়ে শঙ্কা ছিল।

তবে ভোটের দিন বড় কোনো সংঘাত হয়নি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ভোটাররা বলছেন, সংঘাত-সংঘর্ষ ঠেকাতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল বেশ তৎপর।

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে এই উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ২২ হাজার ৪২৬ জন। সদর উপজেলার মোট ১১৭টি ভোটকেন্দ্র। প্রথম আলোর দুজন সাংবাদিক ও একজন আলোকচিত্রী গতকাল ১০টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেন।

গতকাল সকালে ভোট গ্রহণ শুরুর সময়েও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তবে সাড়ে আটটার দিকে বৃষ্টি থামে। ভোট গ্রহণ শুরুর প্রথম দুই ঘণ্টায় চারটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ভোটার উপস্থিতি কম। ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা ভোটারের অপেক্ষায় বসে আছেন।

কুলপদ্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটকেন্দ্রের সামনে বৃষ্টির পানি জমে আছে। ভোটার উপস্থিতি তেমন নেই। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে বোঝা যাচ্ছে না। বৃষ্টির কারণে কম হতে পারে।

আচমত আলী খান পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে নারী ও পুরুষ দুটি ভোটকেন্দ্র। নারী কেন্দ্রটিতে প্রথম দেড় ঘণ্টায় ভোট পড়ে ৭১টি; যা মোট ভোটের ২ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১ ও ৭ নম্বর ভোটকক্ষে ৮টি এবং ৬ নম্বর ভোটকক্ষে ১টি ভোট পড়ে।

এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দীপঙ্কর কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, ভোর থেকে বৃষ্টি হয়েছে। ভোট শুরুর সময়েও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই লোকজন কম এসেছেন। বেলা বাড়লে ভোটার আসবেন।

দত্তকেন্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র ভোটার নেই। ছবিটি বেলা ১ টার দিকে তোলা। মাদারীপুর, ৮মে
ছবি: সাজিদ হোসেন

সকাল সাড়ে আটটার দিকে আচমত আলী খান পাবলিক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন চেয়ারম্যান প্রার্থী আসিবুর রহমান খান। এ সময় তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী চাচা পাভেলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জনসমর্থন দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনগড়া সব অভিযোগ করে যাচ্ছেন। ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু। জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।

কিছুক্ষণ পর একই কেন্দ্রে ভোট দেন আসিবুরের চাচা পাভেলুর রহমান। তিনিও তাঁর ভাতিজা আসিবুর ও ভাই শাজাহান খানের বিরুদ্ধ কালোটাকা বিতরণ, কেন্দ্রে এজেন্ট বের করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ভোটারদের ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। জাল ভোট দেওয়া হচ্ছে।

সমর্থকদের সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ

বেলা ১১টার দিকে উপজেলার বালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল নিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় দুই পক্ষই এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে হাতবোমা ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে আহত হন সাধারণ এক ভোটারসহ উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, বালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল নিতে আসেন আনারস প্রতীকের প্রার্থী আসিবুর রহমান খানের অনুসারী এনামুল হাওলাদার ও তাঁর লোকজন। এ সময় মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী পাভেলুর রহমান খানের অনুসারী আজাদ হাওলাদার তাঁদের বাধা দিতে গেলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপরই উভয় পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। তখন ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে একাধিক হাতবোমা ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলাউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ভোটকেন্দ্রের বাইরে দুই পক্ষের উত্তেজনা থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত। বালিয়া সড়কের দুই প্রান্তে অবস্থান নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, হাতবোমা ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে পুলিশ, বিজিবিসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

মোস্তফাপুর ইউনিয়ন বালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ও আশপাশে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় কেন্দ্রের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। মাদারীপুর, ৮ মে
ছবি : সাজিদ হোসেন

ভোটকেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আল রেজাই রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রের বাইরে বেশ কিছু বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ভোটাররা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ কারণে ঘণ্টাখানেক ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।’

এ কেন্দ্র ছাড়াও ঘটমাঝি ইউনিয়নের ছয়না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুলপদ্বী উচ্চবিদ্যালয়, মস্তফাপুর, কুনিয়া, কালিকাপুর ও কেন্দুয়ায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

গ্রামীণ এলাকায় উপস্থিতি বেশি

সদর উপজেলার পৌর এলাকার তুলনায় গ্রামীণ অংশে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক ভালো ছিল। দুপুরে কেন্দুয়া ইউনিয়নের দত্তকেন্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটারদের উপস্থিতি অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে ভালো। বেলা দুইটা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ১ হাজার ২৩৪টি, যা কেন্দ্রটির মোট ভোটের ৩৫ শতাংশ।

দক্ষিণ কাউয়াকুড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ৯১৯ জন। বেলা আড়াইটার দিকে এই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ১ হাজার ৪৩৪টি; যা কেন্দ্রের মোট ভোটের সাড়ে ৩৬ শতাংশের বেশি।

এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সকালে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটাররা এসেছেন। বিশেষ করে দুপুরের দিকে নারী ভোটাররা বেশি আসছেন। ভোটের হার ৪০ শতাংশের আশপাশে থাকবে।

দুপুরের পর পৌর এলাকার ভোটকেন্দ্রগুলোতেও ভোটার উপস্থিতি বাড়ে। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, তখনো ভোটাররা আসছেন। সে সময় পর্যন্ত চরমুগরিয়া মার্চেন্টস উচ্চবিদ্যালয়ে নারী ও পুরুষ দুটি কেন্দ্রে যথাক্রমে ভোট পড়েছে ২৭ ও ৩৭ শতাংশ।

মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি খান মো. শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী একই পরিবারের হওয়ায় সাধারণ ভোটারদের আগ্রহ তুলনামূলক কম ছিল। সব দলের বা পরিবারতন্ত্রের বাইরে প্রার্থী থাকলে জনগণের ব্যাপক সাড়া দেখা যেত। একই দলের দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা ছিল, তবে ভোটের দিন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট শেষ হয়েছে।