ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্ছেদের শিকার ৩০০ হকার ‘রোজগার হারিয়ে মানবেতর জীবনে’

হকার উচ্ছেদ পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন। ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫; রাজধানীর শাহবাগেছবি: জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সৌজন্যে

ক্যাম্পাস এলাকা থেকে হকার ও ভাসমান উদ্যোক্তাদের উচ্ছেদ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। তারা কয়েকজন গরিব হকারকে লাঞ্ছিত করেছে, যা কোনোভাবেই ডাকসুর দায়িত্ব ও এখতিয়ারভুক্ত নয়। উচ্ছেদের শিকার প্রায় ৩০০ ভাসমান উদ্যোক্তা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতে পারছেন না। রোজগার হারিয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা। উচ্ছেদের নামে হয়রানি বন্ধ চান হকার ও ভাসমান উদ্যোক্তারা।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়েছে। সেখানে উচ্ছেদ হওয়া হকারদের জীবন–জীবিকার পরিস্থিতি নিয়ে শুরু হওয়া জরিপের আংশিক ফলাফল প্রকাশ করে সংগঠনটি। জরিপের অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ৫০ জন নারী–পুরুষ হকারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলেনে উচ্ছেদের শিকার হওয়া নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পানি বিক্রেতার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। তাঁর স্ত্রী বর্তমানে সন্তানসম্ভবা। জীবিকা বন্ধ থাকায় ঘরভাড়া দিতে পারছেন না। এ কারণে বাড়িওয়ালা তাঁদের উচ্ছেদ করেছেন। বর্তমানে এই যুবক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন।

জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কেউ ৩০ বছর, কেউ ২০ বছর আবার কেউ ৬ মাস ধরে হকারের পেশায় যুক্ত আছেন। যে ৫০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জন নারী হকার বা ভাসমান উদ্যোক্তা রয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে হকার উচ্ছেদ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ, শ্রমিকনেতা ও মানবাধিকারকর্মীদের মতামত নিয়েছে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ।

ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বন্ধ বিল্ডিং বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে নয়, বরং অনেক বিস্তৃত। এটি এ রকম একটা জায়গা, যেখানে নানা জায়গা থেকে নানা ধরনের মানুষ আসেন, প্রেমিক-প্রেমিকারা আসেন, সাধারণ মানুষ আসেন, নানা বয়সের মানুষ আসেন। যখন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, তখন থেকেই হকারদের এই সংস্কৃতি চলে আসছে। এই সংস্কৃতি যে তারা বন্ধ করবে, কেন বন্ধ করবে, সেটা বোঝাতে হবে। এখানে পাখি আসবে, কুকুর আসবে, এখানে ভিখিরি আসবে, হকার আসবে—সব ধরনের মানুষ এখানে আসতে পারে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, হকার উচ্ছেদ ডাকসুর দায়িত্ব নয়। কোনোভাবেই এটি মানবিক বা ন্যায়সংগত নয়। হকারদের চাহিদা ও জোগান—দুটোই বিবেচনা করতে হবে। তাঁদের সম্মানজনকভাবে ব্যবসার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব এবং এ বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা করা সম্ভব।

জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শামীম ইমাম বলেন, পরিচ্ছন্নতা অভিযানের কথা বলে উচ্ছেদ করা হলেও এর মূল উদ্দেশ্য হলো শহর থেকে দরিদ্র মানুষদের উপস্থিতি মুছে ফেলা, বৃহৎ পুঁজির মালিকদের মুনাফা সম্প্রসারিত করা এবং শহরকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার উপযুক্ত করে তোলা।

জরিপে অংশ নেওয়া হকার ও ভাসমান উদ্যোক্তারা চারটি সুপারিশ করেছেন। এগুলো হলো—

১. কয়েক দফায় ভাসমান উদ্যোক্তাদের হাঁড়িপাতিল নিয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম। সেই সব মালামাল দ্রুত ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।

২. কিছুদিন পরপর উচ্ছেদের নামে হয়রানি বন্ধ করা হোক। ভাসমান উদ্যোক্তাদের ওপর যে মানসিক-শারীরিক নির্যাতন করা হয়, অতি দ্রুত সেটি বিচারের আওতায় আনা হোক।

৩. প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সিটি কর্পোরেশন বা নিজেদের সমবায় বা ট্রেড ইউনিয়নের পরিচয়পত্র ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হোক।

৪. শুধু সন্দেহের বশে কোনো প্রমাণ ছাড়াই মাদক বিক্রেতা বা মাদক সেবনকারী অ্যাখ্যা দিয়ে যে হকারদের উচ্ছেদ করা হলো, তাঁদের আবার পুনর্বহাল করা হোক।