দ্বৈত জন্মনিবন্ধনের সমস্যা নিয়ে দেড় বছর ঘোরার পর জানলেন কী করতে হবে

জন্মনিবন্ধনপ্রতীকী ছবি

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মো. সেলিমের (৩৩) জন্মনিবন্ধন করা হয়েছিল ২০১০ সালে। তাঁর বাবা এটি করিয়ে দিয়েছিলেন। চলতি বছরের মে মাসে সেলিম তাঁর সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী ছেলের জন্মনিবন্ধন করাতে উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে যান। সেখানে জানতে পারেন, অনলাইনে সেলিমের দুটি জন্মনিবন্ধন রয়েছে। সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে এই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে জানিয়ে ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়।

গাজীপুরের মো. জয়নাল আবেদীন তাঁর মেয়ে জান্নাতুল আক্তার প্রীতির (১৮) প্রথম জন্মনিবন্ধন করেন ২০১৬ সালে। ওই বছর জান্নাতুলের পাসপোর্ট করানো হয়। সে সময় জয়নাল আবেদীন সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। মেয়েসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে ওমরাহ করার জন্য তিনি সৌদি আরব নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ২০২১ সালে জয়নাল আবেদীন তাঁর নাম ‘মো. জয়নাল আবেদীন’ ও মেয়ের নাম শুধু ‘জান্নাতুল’ দিয়ে আরেকটি জন্মনিবন্ধন করান। জয়নাল জানান, পাসপোর্টে তাঁর নামে ভিন্নতা ছিল। অন্যদিকে মেয়ের শিক্ষাগত সনদে ‘জান্নাতুল’ লেখা। তবে গত বছর জান্নাতুলের ই-পাসপোর্ট করাতে গেলে তাঁর নামে দুটি জন্মনিবন্ধন আছে জানিয়ে উত্তরার পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে আবেদন বাতিল করা হয়।

অনলাইনে এমন দ্বৈত জন্মনিবন্ধনের সমস্যায় পড়েছেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বাসিন্দা শহীদুল ইসলামও।

১৬ জুন রাজধানীর রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে এসব ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা করণীয় জানতে এসেছিলেন। সে সময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সেলিম, জয়নাল ও শহীদুলের পুত্রবধূ ফৌজিয়া ইয়াছমিনের সঙ্গে। সমস্যা সমাধানে কেউ দেড় বছর, কেউ সাত মাস, কেউবা দুই মাস ধরে ঘুরছেন। স্থানীয়ভাবে সঠিক তথ্য না পাওয়ায় তাঁদের ভোগান্তি দূর হচ্ছে না।

রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা একাধিক জন্মনিবন্ধন করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই এই সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে। অনলাইনে দ্বৈত নিবন্ধন রয়েছে, এমন ব্যক্তিরা আবেদন করলে একটি বাতিল করা হচ্ছে।

সার্বিকভাবে দেশে এখন জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে কোনো ভোগান্তি নেই উল্লেখ করে যাহিদ হোসেন বলেন, প্রতিদিন নিবন্ধনের উচ্চ সংখ্যাই বলছে, কাজে গতি রয়েছে।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২৫ জুন জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি, ২০ হাজারের বেশি সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি।

‘দেড় বছর পর জানতে পারলাম কী করতে হবে’

জয়নাল আবেদীন গাজীপুর সদর উপজেলায় পরিবার নিয়ে থাকেন। ২৬ বছর সৌদি আরবে থাকার পর ২০২০ সালে দেশে ফিরে আসেন। এখন উত্তরায় এক ব্যক্তির গাড়ির চালান।

জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ের স্বামী লিবিয়াপ্রবাসী। মেয়েকে লিবিয়া পাঠানোর জন্য ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন। গত বছর যখন আবেদন বাতিল হয়, তখন স্থানীয়ভাবে বারবার জানার চেষ্টা করেছেন, কী করতে হবে, কিন্তু কেউ জানাননি। উল্টো এক দালাল ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে তাঁকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এখানে এসে তিনি জানতে পারলেন, একটি জন্মনিবন্ধন বাতিলের জন্য আবেদন করতে হবে।

জয়নাল আবেদীন আক্ষেপ করে বললেন, দেড় বছর ঘোরাঘুরির পর জানতে পারলাম কী করতে হবে। স্থানীয়ভাবে এসব তথ্য জানানো হলে এত ভোগান্তি হতো না।

মো. সেলিমের বাবার নাম মো. হজরত আলী ভান্ডারী, মায়ের নাম জহুরা খাতুন। তাঁর নামে দুটি জন্মনিবন্ধন রয়েছে। ডিএনসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জন্মনিবন্ধন ‘রিসেট’ করতে বলা হয়। তবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে আসার পর তিনি জানতে পারেন, ‘রিসেট’ নয়, তাঁকে জন্মনিবন্ধন হস্তান্তর অর্থাৎ বাতিলের জন্য আবেদন করতে হবে। পরে তা-ই করেছেন। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় তদন্ত করে সেই প্রতিবেদন পাঠাবেন ওয়ার্ড কার্যালয়ে। সে জন্য মাসখানেক সময় লাগবে। এরপর তাঁকে নতুন করে জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে।

সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সাড়ে পাঁচ বছর ও এক বছর বয়সের দুই ছেলেমেয়ে আছে। নিজের জন্মনিবন্ধন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তিনি সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করাতে পারছেন না।

সাত মাস পর সমাধান হলো

নরসিংদীর শহীদুল ইসলামের জন্মনিবন্ধন করানো হয়েছিল মো. শহীদ শেখ নামে, ২০২২ সালে। একই নামে জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়। কিন্তু ছেলেমেয়েদের শিক্ষাগত সব সনদে তাঁর নাম শহীদুল ইসলাম।

শহীদুলের পুত্রবধূ ফৌজিয়া ইয়াছমিন প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৪ সালে শহীদুল ইসলাম নাম দিয়ে তাঁর শ্বশুরের আরেকটি জন্মনিবন্ধন করানো হয়। গত বছরের নভেম্বরে জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করতে গেলে বলা হয়, অনলাইনে দুটি জন্মনিবন্ধন রয়েছে। এটি সংশোধন না করলে জাতীয় পরিচয়পত্রও সংশোধিত হবে না।

ফৌজিয়া ইয়াছমিন বলেন, এর পর থেকে তাঁরা ছুটতে ছুটতে হয়রান। তাঁদের বলা হয়, প্রথম যে জন্মনিবন্ধন রয়েছে, সেটি রাখতে হবে। পরে শ্বশুরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সনদ প্রমাণ হিসেবে জমা দিয়ে প্রথম জন্মনিবন্ধন বাতিলের আবেদন করা হয় ১৬ জুন। পরে ২৭ জুন তাঁদের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, প্রথম জন্মনিবন্ধনটি বাতিল হয়েছে। এদিন ফৌজিয়া স্বস্তি প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, সাত মাস পর সমস্যার সমাধান হলো। এখন তাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে পারবেন।

বেশি লাগার অভিযোগ

‘সার্ভার ডাউন’ ও ই-পেমেন্টের কারণে ২০২৩ সালে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে জনসাধারণকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। ওই সময় সার্ভারের সক্ষমতাও কম ছিল। পরে সার্ভারের সক্ষমতা বাড়ানোসহ আগের মতো হাতে হাতে ফি পরিশোধ ব্যবস্থা রাখায় ২০২৪ সালে ভোগান্তি অনেকাংশে দূর হয়েছিল। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা আত্মগোপনে চলে যান। এ পরিস্থিতিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে আবারও ভোগান্তি শুরু হয়। দুই মাসের বেশি সময় পর্যন্ত বেশির ভাগ জায়গায় নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

পরে প্রশাসক নিয়োগ করে সংকট দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভার ক্ষেত্রে এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন দিচ্ছেন আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সিটিতে সংশোধনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের অনুমোদন লাগে।

জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিয়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কাজের ফলে কোথাও কোথাও বেশি লাগছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, আবেদনপত্রে ভুল থাকার কারণে কোনো কোনো আবেদনকারীর সনদ পেতে সময় বেশি লাগছে। বাকিদের ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে তাঁরা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদ দিয়ে দিচ্ছেন।

তবে উপজেলা পর্যায়ের অনেক ভুক্তভোগীর মতে, ইউএনওরা একই সঙ্গে এলাকার অনেক কাজে যুক্ত থাকেন। মাসে একবার নিবন্ধনের আবেদনগুলোতে সই করার জন্য পৌরসভায় আসেন। এর আগে থানাগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সইও নিতে হয় নিবন্ধনে। তিনিও মাসের কোনো এক দিন আবেদন ফরম যাচাইয়ের পর সই করেন। ফলে নিবন্ধনে সময় লাগছে।

আরও পড়ুন

রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার বাসিন্দা জুলফিকার আলী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়ের জন্মসনদ ডিজিটাল করার জন্য আবেদন করার পাঁচ মাস পর তা পেয়েছিলেন। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি আবেদন করেছিলেন, পেয়েছিলেন মে মাসের মাঝামাঝি। জুলফিকার আলী বলেন, নিবন্ধন পেতে পৌরসভা কার্যালয়ে তিনি কয়েকবার গেছেন। তাঁকে বলা হতো, ‘সই হয়ে আসেনি।’

একই এলাকার আবদুর রাজ্জাক তাঁর মেয়ের মৃত্যুসনদ পেয়েছিলেন এক মাস পর, গত ১৫ মে। ঋণসংক্রান্ত কাজে মেয়ের মৃত্যুনিবন্ধন সনদ পাওয়া জরুরি ছিল। আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর মেয়ে রিশিতা আক্তার (২৬) বেঁচেছিলেন ৯ মাস। গত এপ্রিলে তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতের বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসা করতে গিয়ে ২২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। মেয়ের নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কারণে মেয়ের মৃত্যুনিবন্ধন সনদ জরুরি ছিল।

ছোটাছুটির কথা বলতে গিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘না হলেও ১০ দিন পৌরসভায় গেছি সনদ হয়েছে কি না, তা জানার জন্য। ওখানে না গেলে এই ভোগান্তির কথা কেউ বুঝবে না। শুধু জন্মনিবন্ধন নয়, নাগরিক সনদ নিতেও মাসের পর মাস ঘুরছে মানুষ। আগে এসব সনদ কাউন্সিলরদের কাছে গিয়ে দুই-তিন দিনের মধ্যে পাওয়া গেছে।’

পবার ইউএনও আরাফাত আমান আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধন নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ করার কারণ নেই। তিনি নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে একবারে অনেক সনদে সই করে দেন। ব্যস্ততার কারণে কখনো কখনো কিছুটা দেরি হলেও হতে পারে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন