আবুল হাসনাত সাহিত্য–শিল্পের বিকাশে সারা জীবন কাজ করেছেন

কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাতের ‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় অতিথিরা। বাঁ থেকে প্রজ্ঞা লাবণী, মতিউর রহমান, নাসিমুন আরা হক, নজরুল ইসলাম, মোরশেদ শফিউল হাসান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সিদ্দীকা জামান ও লুভা নাহিদ চৌধুরী। আজ রোববার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে
ছবি: প্রথম আলো

কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত ছিলেন প্রচারবিমুখ। খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত। নেপথ্যে থেকে দেশের সাহিত্য, শিল্প–সংস্কৃতির বিকাশে সারা জীবন একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করে গেছেন তিনি। কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনায় এভাবে তাঁকে স্মরণ করলেন বিশিষ্টজনেরা।

আজ রোববার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি মিলনায়তনে আবুল হাসনাতের প্রবন্ধের বই ‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’–এর মোড়ক উন্মোচন হয়। সেখানে অতিথিরা তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা ও স্মৃতিচারণা করেন। এটি আবুল হাসনাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। বইটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন।

আবুল হাসনাত কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্মনামে। এই অনুষ্ঠান শুরু হয় বাচিক শিল্পী ও সঞ্চালক প্রজ্ঞা লাবণীর কণ্ঠে তাঁর কবিতা ‘স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া সহজ নয়’ আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। ইমেরিটাস অধ্যাপক নগরবিদ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রথমেই আলোচকেরা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।

আলোচনায় ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আবুল হাসনাত ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী মানুষ। তিনি মানুষের ভেতরে সততা ও সংস্কৃতি বিকাশের স্বপ্ন দেখতেন। জাতির সাহিত্য–সংস্কৃতির বিকাশে যাঁরা নীরবে কাজ করে গেছেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

দেড় দশকের বেশি সময় সাহিত্য ও শিল্প–সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলম–এর সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। এর আগে তিনি দুই যুগের বেশি সময় দৈনিক সংবাদ–এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’ সম্পাদনা করেন। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নেন।

সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাত অনন্য ছিলেন উল্লেখ করে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, কার ভেতরে কোন ধরনের মেধা ও সৃজনশীলতা আছে, তা তিনি চট করেই বুঝতে পারতেন। তাদের দিয়ে সেই ধরনের কাজ করিয়েছেন। তিনি বহু লেখককে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে নিজেও ছিলেন উঁচু মানের কবি, প্রাবন্ধিক ও শিল্প সমালোচক। তাঁর নান্দনিক ভাবনা, পরিশীলিত মেজাজ, পরিমিতিবোধ ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রচনায়।

আবুল হাসনাত লেখা ছাপার ক্ষেত্রে লেখক নন, লেখার গুণমানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে তিনি ডাকে সংবাদের সাহিত্য পাতার জন্য লেখা পাঠাতেন। লেখাগুলো সাময়িকীতে গুরুত্বের সঙ্গেই ছাপা হতো। কিন্তু তখন আবুল হাসনাতের সঙ্গে তাঁর সরাসরি পরিচয়ই ছিল না। আবুল হাসনাত স্বল্পভাষী, নেপথ্যচারী লাজুক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল খোলামেলা। গুণীর কদর করতে কার্পণ্য করেননি।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী আবুল হাসনাতের সঙ্গে কাজ করার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁর নীরবে একাগ্রচিত্তে কাজ করে চলা ও বিচিত্র বিষয়ে ব্যাপক পঠন–পাঠনের বিষয়টি তুলে ধরেন। লুভা নাহিদ বলেন, আবুল হাসনাতের দৃষ্টি প্রসারিত ছিল, দৃঢ় সংকল্পের মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর আগেও তিনি কালি ও কলমের বিদ্যাসাগর সংখ্যা নিয়ে কাজ করে গেছেন। বারবার সেটি সম্পন্ন করার কথাই বলেছেন। নতুন প্রজন্মের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ছিল। তিনি মনে করতেন দেশের নতুন প্রজন্মই সব সংকটে জাতিকে উত্তরণের সঠিক পথ দেখাবে।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে আবুল হাসনাতের সঙ্গে পুরান ঢাকার নবাবপুর স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা, ক্রিকেট খেলা, কবিতা লেখা, সাহিত্যচর্চা, ষাটের দশকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, ‘আবুল হাসনাত নেই, এটা বিশ্বাস করতে মন চায় না।’ মতিউর রহমান বলেন, পরবর্তী জীবনে আবুল হাসনাত দেশের সব লেখক, শিল্পীর ঘনিষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাঁর নিজের লেখালেখিও অনেক। ২১টি মৌলিক গ্রন্থ, এককভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২১টি আর যৌথভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২২টি। তাঁর লেখায় শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, ভাবনা উপস্থাপনা উচ্চ মানের। মৃত্যুর পরে যেন তাঁকে আরও গভীরভাবে জানতে পেরেছেন। নির্মোহ মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট সমাজচিন্তক।

সভাপতির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বইটি নিয়ে আলোচনা করে বলেন, এতে ১৫টি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ সমালোচনা রয়েছে ৬টি। প্রতিটি লেখা সুলিখিত, প্রাণবন্ত। গভীর পাণ্ডিত্য আর বিষয়গুলোতে লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ রয়েছে। লেখা দুর্বোধ্য নয়। সব শ্রেণির পাঠকই লেখাগুলো পড়ে যেমন অনেক বিষয়ে জানতে পারবেন, তেমনি আনন্দও পাবেন। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি নিজেও ছিলেন নবাবপুর স্কুলের ছাত্র। স্কুলে আবুল হাসনাতের চেয়ে পাঁচ বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। স্কুল ও পরবর্তী জীবনের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, আবুল হাসনাত নিজে তাঁর কাজের প্রচার করেননি। তবে তাঁর লেখা ভালোভাবে সংরক্ষিত করা ও পরের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে।

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন আবুল হাসনাতের স্ত্রী সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক। তিনি বলেন, আবুল হাসনাতের স্মৃতিরক্ষা ও তাঁর কাজ সংরক্ষণের জন্য আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। ১ নভেম্বর ছিল আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সে উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাঁর সব রচনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ নিয়ে রচনাসমগ্র প্রকাশের পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে।