সুরক্ষা নয়, আইনটি হতে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণমূলক

সরকার ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষার জন্য যে আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে, তা একটি নিয়ন্ত্রণমূলক আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে। আইনটির খসড়ায় উল্লেখিত কিছু বিধিবিধান শেষ পর্যন্ত রাখা হলে তা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২–এর খসড়া নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ আয়োজিত এক পরামর্শ সভায় অংশীজনদের কাছ থেকে এই বক্তব্য উঠে এসেছে। রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে সভাটি আয়োজন করা হয়।

সভায় অংশীজনেরা বলেন, ব্যক্তির তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে ও ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন কোনো আইন হওয়া উচিত নয়। অবশ্য অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ জানান, সবার মতামত নিয়েই আইনটি করা হবে।

আইনমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের তথ্যের সুরক্ষা দিতেই এই আইন, নিয়ন্ত্রণ করতে নয়। তিনি বলেন, সবার মতামত নেওয়া ও আলোচনার পর আইনটি বছর শেষে জাতীয় সংসদে উঠতে পারে।

প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ বলেন, এই আইনের খসড়া নিয়ে প্রত্যেকের উদ্বেগ ও মতামত নোট নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সভায় এসব বিষয় উঠে আসবে।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেবা দিতে মানুষের কাছ থেকে ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। সেসব তথ্য বেহাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশ্বের অন্তত ১৩৭টি দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বা তথ্যের গোপনীয়তা সম্পর্কে দেশীয় আইন রয়েছে। বাংলাদেশে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দিতে সরকার ২০১৯ সালে এ ধরনের একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়। এ বছরের এপ্রিল মাসে আইসিটি বিভাগ উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২ নামে একটি খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও এসব বিষয় আছে এবং আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব ইস্যু ছিল, তা উপাত্ত সুরক্ষা আইনের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
—হুমা খান, মানবাধিকারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, জাতিসংঘ

অবশ্য উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া ও ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একটি প্রবিধানমালা সম্প্রতি অংশীজনদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

আইসিটি বিভাগের সেমিনারে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সাবেক সচিব মো. শহীদুল হক এক উপস্থাপনায় জানান, খসড়াটি নিয়ে ১৯টি প্রতিষ্ঠান থেকে মতামত এসেছে।

অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডেটা প্রটেকশন অথরিটি হচ্ছে এই আইনের সবচেয়ে দুর্বল দিক। সরকার নিজেই এক অংশীজন, নিজে উপাত্ত ব্যবহার করে। তাই সরকারের অধীন কর্তৃপক্ষ হলে তা সাংঘর্ষিক হবে। উপাত্ত সুরক্ষার জন্য একটি কমিশন করা দরকার, যারা স্বাধীন থাকবে।

উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ার ৬৩ ধারায় বলা আছে, বাংলাদেশে সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে ডেটা প্রটেকশন অথরিটির মহাপরিচালককে সরকার যেকোনো নির্দেশ প্রদান করতে পারবে। মহাপরিচালক সেই নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকবেন। এ বিষয় উল্লেখ করে জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও এসব বিষয় আছে এবং আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব ইস্যু ছিল, তা উপাত্ত সুরক্ষা আইনের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তিনি ধারাটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান।

ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, উপাত্ত মজুত ও স্থানান্তরের বিধান ব্যবসায়িক পরিসরকে ভাবিয়ে তুলবে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক সমাজের অংশ। সেখান থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না।

একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, খসড়াটি অনেক অপরিপক্ব। তথ্য নিয়ন্ত্রণ নয়, সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই আইন হওয়া উচিত। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে গেলে যেভাবে জোরপূর্বক তথ্য নিতে অনুমতি নেওয়া হয়, সে বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিতে হবে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধি ইয়োহানেস ভন বলেন, তাঁরা খসড়াটি পর্যলোচনা করছেন। রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁরাও বিভিন্ন উপাত্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিও আছে। খসড়ায় উপাত্ত মজুত ও স্থানান্তরের বিষয়ে আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সভাটি সঞ্চালনা করেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। এতে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির, মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলোর সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব এস এম ফরহাদ, ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।