আট হাজার কোটি টাকা খরচের পরও সংকট 

এক দশকে তিনটি বড় প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৮ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। এরপরও নগরের প্রায় ১২ লাখ মানুষ ওয়াসার পানি নিয়মিত পান না।

চার দিন ধরে পানি পাচ্ছেন না চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজারের পোড়া কলোনির বাসিন্দারা। কখন পানি আসে, সেই অপেক্ষায় ওয়াসার কলের গোড়ায় কলসি ও বালতি দিয়ে রেখেছেন বাসিন্দারা। গতকাল বেলা তিনটায়
ছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম নগরের উত্তর কাট্টলীর কর্নেল জোনস সড়কে পাঁচতলা ভবনে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ ফরিদুর রহমান। তাঁর ভবনে আরও পাঁচ পরিবারের বসবাস। ভবনটিতে ওয়াসার পানির লাইন আছে। কিন্তু সে লাইন দিয়ে পানি বের হয় না। সপ্তাহে এক দিন পানি আসে বটে, থাকে দু-এক ঘণ্টা। তাই বাধ্য হয়ে আশপাশের পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।

মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পানির কষ্টে দিন কাটে তাঁদের। বাড়তি টাকা খরচ করে পানি কিনেও ব্যবহার করতে হয়। সপ্তাহে একদিন পানি আসে, তা–ও থাকে দু-এক ঘণ্টা। কিন্তু মাসে মাসে গড়ে তিন হাজার টাকা করে বিল পরিশোধ করতে হয়। ওয়াসাকে বলেও কাজ হয়নি।

শুধু মিজানুর নন, চট্টগ্রাম নগরে তাঁর মতো এমন আরও অন্তত ১৫ এলাকার প্রায় ১২ লাখ মানুষ ওয়াসার পানি নিয়মিত পান না। তাঁদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি যেমন আছেন, তেমনি আছেন সাধারণ মানুষও। অথচ নগরে পানি সরবরাহের জন্য গত এক দশকে তিনটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি। এতে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৮ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না শহরের সব মানুষ। 

এদেরই একজন মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। নগরের অক্সিজেন এলাকার শহীদ নগরে তাঁর পাঁচতলা ভবন। বছর খানেক আগে তিনি ওয়াসার পানির জন্য সংযোগ লাইন নেন। কিন্তু লাইন নিলেও পানি পাচ্ছেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১৬ বছর আগে গভীর নলকূপ বসিয়েছেন তিনি। বছরখানেক আগে ওয়াসার সংযোগ নেন। সংযোগ নিয়েও পানি পাচ্ছেন না। অথচ প্রতি মাসে বিল দিতে হচ্ছে ৬৬২ টাকা। ওয়াসার কর্মকর্তাদের বারবার বলেও লাভ হয়নি। 

ওয়াসার কর্মকর্তা ও বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরের উত্তর মধ্যম হালিশহর, দক্ষিণ খুলশী, জালালাবাদ, শেরশাহ্‌, আমবাগান, বিশ্বকলোনি, বালুচরা, আমানবাজার, পূর্ব বাকলিয়া, উত্তর কাট্টলী, শুলকবহর, পূর্ব ষোলোশহর, লালখান বাজারের পোড়া কলোনিসহ নানা এলাকায় নিয়মিত ওয়াসার পানি যায় না। দিনে ঘণ্টা দু-এক কখনো থাকে, কখনো তা–ও থাকে না। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা, বালুচরা, আমানবাজারসহ বেশ কিছু এলাকায় এখনো ওয়াসার লাইনই পৌঁছায়নি। 

নির্দিষ্ট এলাকায় সংযোগের অভাব ও পানিসংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উঁচু এলাকা এবং দ্রুত নগরায়ণের কারণে বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি হালদা নদীতে পানি কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদনও কমে গেছে। তাই পানি নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে প্রান্তিক এলাকায় পানি দেওয়ার জন্য আরও একটি বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। 

গত সোমবার লালখান বাজারের পোড়া কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, খুপরির মতো একেকটা ঘর। প্রতিটি ঘরের সামনেই বালতি, কলসি, ড্রাম রাখা। সেখানে জমিয়ে রাখা হয়েছে পানি। আবার কলের গোড়ায় খালি কলসি সারি সারি রাখা। পানি আসবে—সে আশায় দাঁড়িয়ে আছেন বাসিন্দারা। 

পানির জন্য অপেক্ষারত বৃদ্ধা উষা রানী মণ্ডল বলেন, গত প্রায় ১৬ বছর তিনি ওই এলাকায় থাকেন। কিন্তু ওয়াসার পানি তিনি নিয়মিত পান না। গভীর নলকূপ থেকে দিনে তিনবার পানি আসত কয়েক দিন আগেও। কিন্তু গত তিন দিন তা–ও আসেনি। মিনু আক্তার নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘কখনো তিন দিন পানি আসেনা, কখনো আসেনা টানা সাত দিন। পানি এলে জমিয়ে রাখি। সেই পানি দিয়ে দিন চলে। এমনকি প্রতিদিন গোসলও করা যায় না।’

নগরবাসীর পানির চাহিদার শত ভাগ পূরণে ওয়াসাকে আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একসময় নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতেও পানি পাওয়া যেত না। এখন সে পরিস্থিতি বদলে গেছে। ইতিমধ্যে পানি সরবরাহের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি ঘরে ঘরে ২৪ ঘণ্টা পানি সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। এ কারণে আরও কিছু প্রকল্পের উদ্যোগ নিতে হবে এবং তা ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।