যাত্রা করল দ্বাদশ সংসদ, ভোট বর্জনের সমালোচনায় রাষ্ট্রপতি

জাতীয় সংসদ ভবনফাইল ছবি

যাত্রা শুরু করেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে টানা চতুর্থবারের মতো স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। আর এবারও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন শামসুল হক।

বিগত একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। এর পরদিন গতকাল ৩০ জানুয়ারি বসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। এই সংসদের সদস্যরা একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গত ১০ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন। এ নিয়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছিল।

দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুর দিনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ভাষণে এসেছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর সমালোচনা। রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, নির্বাচন ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাতের সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। প্রসঙ্গত, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট নির্বাচন বর্জন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিল।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার কিছু সময় আগে সংসদ কক্ষে আসেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের অনেককে সংসদ নেতার পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেখা যায়। অধিবেশন শুরু হলে স্পিকার–ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

স্পিকার–ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন

একাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হকের সভাপতিত্বে বৈঠকের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচন করা হয়। স্পিকার পদে শিরীন শারমিন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। আর কোনো প্রার্থী না থাকায় শিরীন শারমিন চৌধুরী সর্বসম্মতিক্রমে স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন বলে ঘোষণা দেন স্পিকারের আসনে থাকা শামসুল হক।

স্পিকার নির্বাচনের পর অধিবেশন কিছু সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া হয়। এ সময় সংসদ ভবনে স্পিকার হিসেবে শিরীন শারমিন চৌধুরীকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে আবার অধিবেশন শুরু হয়। তখন স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে সংসদে বক্তব্য দেন সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, দীপু মনি এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

সংসদে বিরোধী দলের নেতা জি এম কাদের দ্বাদশ সংসদে নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ কখনো নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে না, এমন আশঙ্কা অবাস্তব নয়। এই সংসদ জাতিকে কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।

স্পিকারকে ধন্যবাদ জানানো বক্তৃতা পর্ব শেষ হলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচন হয়। শামসুল হক এবারও এই পদে নির্বাচিত হয়েছেন। সরকারি দলের সংসদ সদস্য এ বি তাজুল ইসলাম ডেপুটি স্পিকার পদে শামসুল হকের নাম প্রস্তাব করেন। সরকারি দলের সদস্য মকবুল হোসেন ওই প্রস্তাব সমর্থন করেন। অন্য কোনো মনোনীত প্রার্থী না থাকায় স্পিকার কণ্ঠভোটের মাধ্যমে ডেপুটি স্পিকারকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের জন্য পাঁচ সদস্যদের সভাপতিমণ্ডলীও মনোনয়ন করা হয়। তাঁরা হলেন এ বি তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, আ ফ ম রুহুল হক, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, উম্মে কুলসুম। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে নামের ক্রমানুসারে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন।

এরপর শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শোকপ্রস্তাবটি পেশ করেন। শোকপ্রস্তাবে কুয়েতের আমির শেখ নাওয়াফ আল আহমদ আল জাবের আল সাবাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী জিনাতুন নেসা তালুকদার, সাবেক সংসদ সদস্য ড. মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীসহ বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।

‘অরাজকতা’ সৃষ্টির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বললেন রাষ্ট্রপতি

স্পিকার-ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনসহ দিনের অন্যান্য কার্যসূচি শেষে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি দীর্ঘ বক্তব্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দেশের উন্নয়ন, সংসদ ও সংসদ সদস্যদের ভূমিকাসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন।

কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, নির্বাচন ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাতের সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তিনি বলেন, তাদের গণতন্ত্রবিরোধী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখলেও গণতন্ত্রের শাণিত চেতনা ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সব পদক্ষেপ সার্থক হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ-ও বলেন, নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে। তবে কেউ যাতে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমাল ও জীবিকার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করায় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান রাষ্ট্রপতি।

রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর সংসদের অধিবেশন আগামী রোববার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

দেশের বিশিষ্টজন ও ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা সংসদে উপস্থিত হয়ে অধিবেশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। সংসদ সচিবালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, চীন ও ভারতের রাষ্ট্রদূতসহ প্রায় ৮০টি দেশের কূটনীতিক দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে উপস্থিত ছিলেন।

বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছেন ২২৩ জন। ক্ষমতাসীন দলের মিত্র জাতীয় পার্টি ১১ জন সংসদ সদস্য নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেছে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রয়েছেন ৬২ জন। তাঁদের ৫৮ জনই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে রয়েছেন। এ ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টির একজন করে সংসদ সদস্য রয়েছেন।