আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ১৫ দফা দাবি তুলে ধরেছে।
১০ ডিসেম্বর (আজ বুধবার) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ উপলক্ষে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে মানবাধিকার সংগঠনটি। এ সময় জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগঠনটি ১৫ দফা দাবি তুলে ধরেছে।
কর্মসূচিতে অংশ নেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাঁদের পরিবার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ‘স্পিক আপ’ প্রকল্পের তরুণেরা। এই মানববন্ধন কর্মসূচিতে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা হয়।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের এ দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। এ ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকৃত হয়, মানবাধিকার সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। জন্মস্থান, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে মানবাধিকার সর্বজনীন ও সবার জন্য সমান। প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবেই এসব অধিকার লাভ করেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) উপদেষ্টা মাবরুক মোহাম্মদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের বাইরে গিয়েও প্রতিদিনই মানবাধিকার বিষয়ে জাগ্রত ও সোচ্চার থাকতে চাই। আইন ও সালিশ কেন্দ্র কখনো মানবাধিকার বিষয়ে কারও কাছে মাথা নত করেনি, কারও সঙ্গে আপস করেনি। যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, সেখানেই আইন ও সালিশ কেন্দ্র সব সময় সোচ্চারভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে।’
নারী অধিকারের বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে সংস্থার এই উপদেষ্টা মাবরুক মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘আইনের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে কিন্তু নারী ও শিশুর প্রত্যয়ী সহিংসতাগুলো বন্ধ হয়নি। এটি নিয়েও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে মাবরুক মোহাম্মদ বলেন, এসব অধিকারের ওপর বিগত নানা সরকারের সময় আঘাত এসেছে। এখনো পরিস্থিতি খুব আশাব্যঞ্জক নয়। কিছু জায়গায় উন্নয়ন হয়েছে, আবার কিছু জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। সেই জায়গাগুলো নিরাপদ করার প্রত্যাশা আছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে যে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, সেই বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকারের যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তাই আমাদের প্রত্যাশা।’
এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানুষের জীবনের অধিকার হরণ করার অধিকার কারও নেই উল্লেখ করে আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘আমরা মনে করি সংবিধানপ্রদত্ত জীবনের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। এ দেশের একটি মানুষও যেন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার না হয়, সেই দাবি আমাদের সবসময় থাকবে।’
১৫ দফা দাবি
‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভিত্তি হোক মানবাধিকার’—এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ২০২৫–এ জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ১৫ দফা দাবি তুলে ধরেছে।
১. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, যেমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখতিয়ারবহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে এবং সম্পৃক্তদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি দিতে হবে।
২. এখন পর্যন্ত সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. এখন পর্যন্ত যত গুমের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তার প্রতিটির যথাযথ তদন্ত সম্পূর্ণ করতে হবে এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৪. দেশের যেকোনো নাগরিককে আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
৫. মিথ্যা মামলাসংক্রান্ত যে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো আমলে নিয়ে অভিযোগের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৬. নাগরিকের সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি এবং জনদুর্ভোগ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারত্বের আওতায় রেখে তাদের কর্মপরিধি নিশ্চিত করতে হবে।
৮. নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে।
৯. ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে যেন কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে, তার জন্য পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ বিশ্বাস ও রীতি চর্চার অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
১০. শিল্প সংস্কৃতির চর্চা নির্বিঘ্নে করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তৌহিদি জনতার নাম ধারণ করে মব সন্ত্রাস করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শিল্প-সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র ভাঙচুর, নারী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হেনস্থাকারী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
১১. জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন পুনর্গঠনে কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
১২. পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১৩. কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১৪. অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও সহযোগিতায় বিদেশি দূতাবাসগুলোতে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর চালুসহ অন্যান্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে।
১৫. সর্বোপরি, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে হবে।