সাপের খেলা দেখতে চায় না কেউ, দিনমজুরি করেন মিরসরাইয়ের বেদেরা

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের বেদে পল্লি। সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

বেদে সম্প্রদায়ের কথা উঠলেই সাপের খেলা দেখার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। গ্রামীণ বাজার, বটতলায় বা গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় নানান ধরনের সাপের নাচ আর ভেলকি দেখিয়ে মানুষ জমাতেন বেদেরা। পরে কথায় ভুলিয়ে সাপে কাটাসহ বিভিন্ন রোগের ‘অব্যর্থ’ ওষুধ বিক্রি করে রোজগার সেরে সেখান থেকে সটকে পড়তেন। সাপের খেলা দেখানো ছাড়াও সাপ ধরা, তন্ত্রমন্ত্র, বানরের খেলা দেখানো, ভাগ্য গণনা, শিঙা লাগানো (গরু বা মহিষের শিং দিয়ে বিশেষ কায়দায় বদ রক্ত চুষে নেওয়ার পদ্ধতি), দাঁতের পোকা ফেলা, গয়না খোঁজার কাজগুলো ছিল বেদেদের আদি পেশা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদি পেশা থেকে সরে আসছেন তাঁরা।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড দুটিতে ৪০০ পরিবারে প্রায় তিন হাজার বেদে জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। সমতল এলাকায় থাকা এসব বেদে দ্রুত আদি পেশা পরিবর্তন করে থিতু হচ্ছেন অন্য কিছুতে।

পাড়াটির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাঁচ বছর আগেও পাড়াটির ২০০ জন পুরুষ হারিয়ে যাওয়া গয়না খোঁজার কাজ করতেন। এখন পুকুর কমে যাওয়া ও ঘরের ভেতর গোসল করার প্রবণতা বাড়ায় এ পেশাটি আর টিকছে না। পাড়ায় এখন এ পেশার লোক আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। এটির মতো বানরের খেলা দেখানো, সাপের নাচ দেখানো, তন্ত্রমন্ত্র, শিঙা লাগানোর পেশাও ছাড়ছেন বেদেরা। এখন বেশির ভাগ বেদেই দিনমজুরি করে সংসার চালান।

বেদেপাড়ার প্রবীণ ব্যক্তি ও পাড়ার সরদার ইমরান হোসেন (৬০) যুবক বয়সে পুরো দেশে ঘুরে ঘুরে বানরের খেলা দেখাতেন। শারীরিক সামর্থ্য থাকলেও এখন এই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। সরদার বলেন, যুগ বদলে গেছে। প্রযুক্তি হাতের নাগালে চলে আসায় মানুষ এখন সচেতন। ভাগ্য গণনা, তন্ত্রমন্ত্র আর ঝাড়ফুঁকে মানুষ আর বিশ্বাস করে না। মোবাইল ফোন খুললেই বিনোদনের অভাব নেই। তাই বানরের খেলা আর সাপের নাচ মানুষের মন ভরাতে পারে না এখন। এসব পেশায় আয়রোজগার কমে যাওয়ায় বেদেদের পেটে ভাত জোটে না। তাই গত ১০ বছরে এসব আদি পেশা বদলে নতুন নতুন কাজে যুক্ত হচ্ছেন বেদেরা।

বানরের খেলা দেখানো এক বেদে। সম্প্রতি মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের বেদে পল্লিতে
প্রথম আলো

নতুন কী কাজ যোগ দিচ্ছেন বেদে লোকজন, জানতে চাইলে সরদার বলেন, বেদে লোকজনের মধ্যে শিক্ষার হার একেবারে কম। তাই অফিস–আদালতের চাকরিতে যুক্ত হতে পারেন না তাঁরা। রিকশা, অটোরিকশা চালানো ও দিনমজুরিতে যুক্ত হচ্ছেন অধিকাংশ বেদে। অনেকে দোকানপাটের সহকারী হিসেবেও কাজ নিচ্ছেন।

এ পাড়ার বাসিন্দা আকতার হোসেন ৩০ বছর ধরে বানরের খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, আগের তুলনায় আয় অনেক কমে গেছে। এখন মানুষ আর বানরের নাচ দেখতে চায় না। মানুষের সব আনন্দ এখন মোবাইল ফোনে।

জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, এখানকার বেদেদের জীবনাচার এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আদি পেশাগুলোর কদর কমায় সেসব বদলে এখন প্রচলিত পেশাগুলোতে চলে আসছেন তাঁরা। তবে পড়ালেখায় পিছিয়ে থাকায় দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে পারছেন না এ সম্প্রদায়ের লোকজন।