‘কতবার কইছিলাম, খালপাড়ে যাইস না’

গত শনিবার পাঁচ বছর বয়সী আবদুল্লাহর নিথর দেহ মহেশখাল থেকে উদ্ধার করা হয়।

আবদুল্লাহ

বেড়ার ছোট্ট একটা ঘর। টিনের চালাটাও ফুটো। ঘরের ভেতর পুরোনো ভাঙা একটা চৌকির ওপর ছড়িয়ে আছে পাঁচ বছর বয়সী আবদুল্লাহর জামাকাপড়। এক পাশে পড়ে আছে স্বরবর্ণ শেখার একটা বই। চৌকির এক পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন বিবি লাইজু। ক্ষণে ক্ষণে বিলাপের সুরে বলছিলেন, ‘কেন খেলতে গেলি রে আমার মানিক। কতবার কইছিলাম, খালপাড়ে যাইস না। কেন গেলি?’

লাইজুর বুকফাটা আহাজারি শুনে ছোট্ট ঘরে উপস্থিত জনা দশেক প্রতিবেশী আর স্বজনও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। লাইজুকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও বুঝি হারিয়ে ফেলেছেন তাঁরা।

২৩ বছর বয়সী বিবি লাইজু চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের বাদশা মিয়া ব্রিক ফিল্ড এলাকার শফিক সাহেবের কলোনিতে ভাড়া থাকেন। তাঁর বাসার পাশেই মহেশ খাল। গত শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে লাইজুর বড় ছেলে আবদুল্লাহ নিখোঁজ হয়। পরে গত শনিবার বেলা একটার দিকে আবদুল্লাহর নিথর দেহ মহেশখাল থেকে উদ্ধার করা হয়। সিডিএ আবাসিক এলাকায় খালের অংশে তাকে পাওয়া যায়। পরে মরদেহ পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে।

আরও পড়ুন

গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে বাদশা মিয়া ব্রিক ফিল্ড এলাকার শফিক সাহেবের কলোনিতে গিয়ে দেখা গেল, ছেলের শোকে বিলাপ করেছেন লাইজু। মাঝেমধ্যে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তাঁর স্বামী মো. কামাল (২৬) তখনো হাসপাতালের মর্গে ছেলের লাশের অপেক্ষায়।

অভিশপ্ত খালপাড় থেকে বাসা ছেড়ে চলে যাবেন বলে জানালেন আবদুল্লাহর মা লাইজু। ছেলে নেই এই নির্মম সত্য মানতে পারছিলেন না তিনি। সামনে যাঁকে পাচ্ছেন, তাঁকেই বলছিলেন, ‘আমি বাসা ছাইড়া চইলা যামু। আমার ছেলেটারে ফিরাইয়া দেন। আর কিচ্ছু চাই না, ছেলেটারে চাই।’

মো. কামাল ও লাইজুর বাড়ি ভোলার চর ফ্যাশনে। নদীর ভাঙনে ভেসে গেছে বাড়িঘর। বছর ছয়েক আগে তাঁদের বিয়ে হয়। বর্তমানে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা লাইজু। আবদুল্লাহ ছাড়াও তাঁদের দেড় বছর বয়সী আরেক সন্তান রয়েছে। তার নাম মো. ইয়াসিন।

লাইজু জানালেন, নদী ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন কিছুই নেই। বছর পাঁচেক আগে তাঁরা চট্টগ্রামে আসেন। কামাল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ১৩ হাজার টাকা বেতন পান। আর তিনি ভিক্ষা করেন। বাসাভাড়া বাবদ দিতে হয় আড়াই হাজার টাকা। লাইজু বলেন, ‘অভাব-অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী। কোনো রকমে বাঁইচা আছি।’

লাইজুর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ইয়াসিন ছিল তার নানি বিবি আফুজার কোলে। রোগা পাতলা ছেলেটার হাতে ছিল বড় ভাই আবদুল্লাহর ছবি। মায়ের আহাজারি দেখে সেও কাঁদছিল। কোনোরকমে কান্না থামিয়ে লাইজু বলেন, ‘প্রতিবছর কেউ না কেউ পড়ে আহত হয়। না হয় মারা যায়। তারপরও খালের পাশে কিছু দেওয়া হয় না।’

আরও পড়ুন

একের পর এক মৃত্যু

গত তিন বছরে চট্টগ্রাম নগরের নালা ও খালে পড়ে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৭ আগস্ট নগরের আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়ায় ইয়াছিন আরাফাত নামের দেড় বছর বয়সী এক শিশু নিখোঁজ হয়। ১৬ ঘণ্টা পর তার নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর বাদামতলা এলাকার নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের (২০)।

২০২১ সালের ৩০ জুন মেয়র গলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই বছরের ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুরে চশমা খালে পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। তাঁর মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি।

এরপর ৬ ডিসেম্বর একই খালে তলিয়ে যায় শিশু মো. কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর নগরের মির্জা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন