একটা চিকন সিঁড়ি। টুকটুক করে উঠে গেলে দোতলার ওপর একটা কাঠের সেতু। নতুন বড় বিল্ডিং থেকে পাশের পুরোনোটায় যাওয়ার এটাই পথ। হেঁটে যাওয়ার সময় ঠকঠক শব্দ হয়। বেশ রহস্যময় শব্দ। সিঁড়ি, সেতু, বারান্দা সব জায়গাতেই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে বই। নানা রঙের, নানা ঢঙের, নানা আকৃতির। বারান্দা ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকের ঘরটাতেই পাওয়া গেল রকিব হাসানকে। জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘তিন গোয়েন্দা’র লেখক রকিব হাসান কী যেন একটা লিখছিলেন। কালো প্যান্ট, ক্রিম কালারের শার্ট আর চোখে চশমা। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। কাটা কাটা শব্দে বেশ গুছিয়ে কথা বলেন তিনি। আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল—
এই সিরিজের নাম তিন গোয়েন্দা রাখলেন কেন?
রকিব হাসান: এক বাক্যে তাঁর উত্তর—তিনজন গোয়েন্দাকে নিয়ে লেখা, তাই।
কিশোর, মুসা, রবিন—এই নামগুলোই কেন রাখলেন? এ রকম কোনো চরিত্র আপনার আশপাশে আছে কি?
রকিব হাসান: না, এ রকম কোনো চরিত্র আমার আশপাশে নেই। কিশোর পাশা, মুসা আমান, রবিন মিলফোর্ড নাম তিনটি দ্রুত উচ্চারণের সময় একটা ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। আর ‘কিশোর’ নামটা রেখে বোঝাতে চেয়েছি এ বই কিশোর বয়সীদের বই, সেটা ছেলেই হোক বা মেয়েই হোক।
রকি বিচটা কোথায়? এই প্রেক্ষাপটে কেন তিন গোয়েন্দা লিখলেন?
রকিব হাসান: রকি বিচ আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। এই প্রেক্ষাপটে ‘তিন গোয়েন্দা’ লেখার প্রধান কারণটা হলো, বাংলাদেশের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা ওখানে অনেক বেশি। তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারটার কথাই ধরা যাক, স্যালভিজ ইয়ার্ডের জঞ্জালের নিচে মোবাইল হোমের ভেতর। অনেকগুলো গুপ্তপথ রয়েছে এর। বাংলাদেশে সে রকম স্যালভিজ ইয়ার্ড কোথায়? খুঁজলে যদিও বা দু–চারটা পাওয়া যায়, সেগুলোর অবস্থান যেসব জায়গায়, সেখানে কয়েকটা কিশোর ছেলের গোয়েন্দাগিরির জন্য হেডকোয়ার্টার বানানো সম্ভব কি না, পরিবেশ উপযুক্ত কি না, সামাজিকতায় মিলবে কি না, এ রকম বহু প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। রকি বিচকে বেছে নেওয়ার আরেকটা কারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানটায় অপূর্ব সাগর আছে, পাহাড় আছে, বন-জঙ্গল, নদী-নালা সব আছে; সেই সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে আধুনিক শহরের সব সুযোগ-সুবিধা। এসব বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছে রকি বিচই তিন গোয়েন্দার উপযুক্ত স্থান।
জিনা ও রাফিয়ান সম্পর্কে কিছু বলুন।
রকিব হাসান: জিনা অর্থাৎ জর্জিনা পারকার বিরাট বড়লোকের একমাত্র মেয়ে। কিছু বদমেজাজি আর দুর্বিনীত হলেও মনটা তার খুবই ভালো আর অতিরিক্ত নরম। দুঃসাহসী। উদার। একরোখা। খেয়ালি। প্রকৃতিপ্রেমিক। অ্যাডভেঞ্চারপাগল। নৌকা নিয়ে একা একা উত্তাল সাগরে বেরিয়ে পড়তেও ভয় পায় না সে। রাতদুপুরে চলে যায় নিজের দ্বীপে বেড়াতে। জিনার কুকুর রাফিয়ান কোনো ‘বড়লোক কুকুরের’ একমাত্র ছেলে না হলেও মনিবের সঙ্গে তার স্বভাবের বেশ মিল। বিশালদেহী মাংগরল কুকুরটার চেহারা যত ভয়ংকরই হোক, মনটা তারও খুব নরম। হাসিখুশি। শত্রুকে ছেড়ে কথা কইবে না কিন্তু বন্ধুর জন্য জীবন বাজি। সেও প্রকৃতিপ্রেমিক, দুঃসাহসী, অ্যাডভেঞ্চারপাগল। সবচেয়ে বড় কথা, জিনার মতোই সেও তিন গোয়েন্দার ভক্ত।
তিন গোয়েন্দা এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কী বলেন মনে করেন?
রকিব হাসান: প্রথমত এতে কিশোরদের কাহিনিতে কিশোর-কিশোরীরাই মূল চরিত্র। দ্বিতীয়ত, শেখার কিছু না কিছু থাকে প্রায় প্রতিটি বইতেই। এবং তৃতীয়ত, এ বই ছোট-বড় যেকোনো বয়সের পাঠক নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন। এমন কিছু থাকে না এতে, যা দেখলেই ছোটদের পড়তে বাধা দেবেন বড়রা। মা–বাবা কিংবা বড় ভাইবোনেরা নিঃসংকোচ তাঁদের ছেলেমেয়ে, ছোট ভাইবোনদের কিনে দিতে পারেন। মোট কথা, ‘এই বই পড়লে খারাপ হয়ে যাবে’—অভিভাবকদের এই বাক্য বোধ হয় প্রযোজ্য নয় ‘তিন গোয়েন্দা’র ক্ষেত্রে, যার কারণে সিরিজটা পারিবারিক সিরিজে পরিণত হয়েছে। কোনো বই পারিবারিক হয়ে গেলে সেটা জনপ্রিয় হতে বাধ্য।
আপনার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে, কেমন কেটেছে?
রকিব হাসান: আমার ছেলেবেলা কেটেছে ফেনী শহরে। থাকতাম মাস্টারপাড়ার হাজারী বাড়িতে। আমাদের বাড়িওয়ালা ছিলেন সোনা মিয়া হাজারী। তাঁর মতো ভালো লোক আমি কমই দেখেছি জীবনে। তাঁর ছেলে ‘ননু’ ছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু। স্কুলজীবনের শুরু এবং শেষ আমার ফেনী শহরেই। এসএসসি পাস করেছি ফেনী পাইলট হাইস্কুল থেকে। পুরো এক যুগ অর্থাৎ ১২টি বছর কাটিয়ে, ফেনী কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে যখন পড়ছি, তখন চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময় হলো বাবার। ফেনী ছাড়তে বাধ্য হলাম। জীবনের সোনালি একটা টুকরো কেটেছে আমার ফেনীতে, যে ফ্যান্টাসি জগতে। সেসব কথা ভাবতে গেলে, কিংবা এই যে ছোটবেলার কথা বলতে বসেছি, নিজের অজান্তেই কখন যে চোখ ভিজে এসেছে, জানি না। ঠেকাতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে: ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না...।’
তখন বই কেমন পড়তেন? কীভাবে পড়তেন? লুকিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা, দু-একটা ঘটনা।
রকিব হাসান: বই গোগ্রাসে গিলতাম। যা পেতাম, যে ধরনের বই পেতাম, সব পড়তাম। কিনে পড়তাম, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়তাম, স্কুলের লাইব্রেরিতে পড়তাম। তারপরও বইয়ের আকাঙ্ক্ষা মিটত না। মনে হতো আরও চাই, আরও চাই—দুনিয়ার সব বই এনে দেওয়া হোক আমাকে। নির্জন পচা পুকুরের পাড়ে ছিপ ফেলে বই হাতে বসে থাকতাম। একবার একটা কাকতালীয় মজার কাণ্ড ঘটেছিল। বইয়ের গল্পের চরিত্রদের নৌকাটাকে তখন মাঝসাগরে টেনে নিয়ে চলেছে কল্পিত ভয়াবহ মকর মাছ। ঠিক ওই সময় আমার ছিপটাকেও টেনে নিয়ে চলে শোল, গজার, বোয়ালজাতীয় কোনো বড় মাছ। কোনো মাছ দেখিনি। কাছিম হলে অবশ্য বুদ্বুদ উঠত, চিনতে পারতাম। ছিপটাকে উদ্ধার করতে পারিনি। কারণ ওই পুকুরে নামার সাহস আমার ছিল না, ভুতুড়ে সিন্দুকের ভয়ে। পায়ে শিকল পেঁচিয়ে কখন টান দিয়ে নিয়ে যাবে পানির তলায় কে জানে! যাহোক, লুকিয়ে বই পড়ার প্রয়োজন আমার হতো না। কারণ, আমাদের পরিবারটা ছিল মোটামুটি বইপড়ুয়া। আমার মেজ বোন স্কুল থেকে কোনো বই নিয়ে এলে সেটা নিয়ে তার সঙ্গে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিতাম। মাঝেমধ্যে আব্বাও যোগ দিত তাতে। মনে আছে, জুল ভার্নের ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ বইটার অনুবাদগ্রন্থটা যখন স্কুল থেকে নিয়ে এলাম আমি, কাড়াকাড়ির চোটে ছিঁড়ে গিয়েছিল। বাঁধাই খরচের গচ্চাটা শেষে আব্বার পকেট থেকেই গিয়েছিল।
আপনার ছোটবেলার পড়া প্রিয় বই, প্রিয় চরিত্রের মধ্যে দু-একটার কথা বলুন।
রকিব হাসান: ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় বই ছিল ‘উইজার্ড অব দ্য ওজ’। বইটা আগাগোড়া পড়েছি উনিশবার। টুকরো টুকরোভাবে কিছু কিছু জায়গা যে কতবার পড়েছি, হিসাব রাখিনি। এর সব কটা প্রধান চরিত্রই আমার খুব প্রিয়। ছোট্ট মেয়ে ডরোথ, তার প্রিয় কুকুর টিটো, টিনের মানুষ, কাকতাড়ুয়া, পুতুল, ভীত সিংহ—সব, সব চরিত্র আমার ভীষণ প্রিয়। বইটা অনুবাদ করার আমার বিশেষ ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হাসিমুখে কেড়ে নিয়ে গেলেন প্রিয় সুহৃদ আসাদুজ্জামান। নিয়ে গিয়ে ভালোই করেছেন। তার মতো এত ভালো অনুবাদ বইটার আমি করতে পারতাম না।
মা, বাবা, ভাই, বোন সম্পর্কে বলুন।
রকিব হাসান: বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। মা গৃহিণী। দুজনের কেউই আর এখন নেই। আমার কোনো ভাই নেই। তিন বোন। এক বোন বড়। বাকি দুজন ছোট।
ছোটবেলায় পড়ার পরিবেশ কেমন ছিল? কে উৎসাহ দিত?
ছোটবেলায় পড়ার পরিবেশ কেমন ছিল, সেটা আগেই বলেছি। কেউ উৎসাহ দেয়নি, নিরুৎসাহিতও করেনি। মোট কথা বই পড়ায় আমার ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। সেটা যে ধরনের বই–ই হোক না কেন। হাতে গল্পের বই দেখলেই যেমন ‘খেউ খেউ’ করে তেড়ে আসেন কিছু অভিভাবক। পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়লেই জগৎসংসার উচ্ছন্নে গেল এমন ভাব দেখান, তাঁদের কবলে যে আমি পড়িনি, সেটা এক বিরাট সৌভাগ্য। ‘আব্বা’কে ধন্যবাদ, আম্মাকেও। কারণ, বই কেনার টাকা চাইলে তিনি কখনো না করতেন না।
আপনার লেখক হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
রকিব হাসান: সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার ও ‘মাসুদ রানা’র লেখক জনাব কাজী আনোয়ার হোসেনের।
আপনার প্রিয় লেখক কে? কেন তিনি প্রিয়?
রকিব হাসান: দেশে-বিদেশে অনেকেই আমার প্রিয় লেখক। তবে একজনের নাম করা যেতে পারে, তিনি ইংরেজ লেখক উইলভার স্মিথ। থ্রিল, মিস্ট্রি, অ্যাডভেঞ্চার, অ্যাকশন মিলিয়ে এমন সব কাহিনি তিনি লেখেন, পড়তে গিয়ে কোথা দিয়ে যে রাত পার হয়ে যায়, টেরও পাই না। পাঠককে আটকে রাখার ক্ষমতা তীব্র সীমাহীন।
‘তিন গোয়েন্দা’ আপনার কাছে কেমন লাগে?
রকিব হাসান: ভালো। খুব ভালো।