চিত্রমেলায় প্রকৃতির নান্দনিক রূপায়ণ
পাশাপাশি দুটি নৌকা ঘাটে ভিড়ে আছে। এ ধরনের নৌকা এখন আর বিশেষ দেখা যায় না। বিশাল আকারের এই নৌকাগুলোর এক প্রান্তের গলুই থেকে শুরু করে আরেক প্রান্তের গলুইয়ের কাছাকাছি অবধি দোচালা ঘরের মতো বাঁশের কাঠের ছাউনি দেওয়া। পাল তোলার জন্য লম্বা মাস্তুল। মাঝি হাল ধরে বসে আছে নৌকার সেই ছাদের ওপর। নেপথ্যের পটভূমিতে নীলাভ আকাশ।
১৯৭৯ সালে গোয়াশ মাধ্যমে ছবিটি এঁকেছিলেন দেশের প্রথম প্রজন্মের অন্যতম প্রধান চারুশিল্পী আমিনুল ইসলাম। তাঁর এই শিল্পকর্মসহ দেশের খ্যাতনামা ও নবীন ৯০ জন শিল্পীর ৯০টি শিল্পকর্ম নিয়ে ‘চিত্রমেলা’ নামে যৌথ শিল্পকর্মের প্রদর্শনী চলেছে লালমাটিয়ার সি ব্লকের ২/৬-এর গ্যালারি দ্য ইলিউশনে।
চারুকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান জলেরধারা ফাইন আর্টস এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে তাদের চতুর্দশ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে। বিশিষ্ট শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা বীরেন সোমের পরিচালনায় ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী সোহাগ পারভেজের তত্ত্বাবধানে জলেরধারার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে।
মূলত জলরঙের চর্চা, প্রশিক্ষণ ও জলরঙের ছবির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়েই জলেরধারা কাজ শুরু করেছিল। পরে শিল্পকলার অন্যান্য মাধ্যমেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি গড়ে উঠলেও জলরঙের কাজের প্রতি তাদের বিশেষ গুরুত্ব আগের মতোই রয়েছে।
গত ১৪ বছরের কার্যক্রমে জলেরধারা ফাইন আর্টস চারুকলায় ডিপ্লোমা কোর্সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের সঙ্গে শিল্পীদের নিয়ে নিয়মিত প্রদর্শনী, কর্মশালা, আর্ট ক্যাম্প, আর্ট ট্রিপের আয়োজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার থেকে চিত্রমেলা নামের এই প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ১২ অক্টোবর অবধি চলবে এই প্রদর্শনী।
ছবিমেলায় স্বাভাবিকভাবেই জলরঙের ছবিরই প্রাধান্য। এর সঙ্গে অ্যাক্রিলিক, প্যাস্টেল, চারকোল, রেখাচিত্র আর মিশ্রমাধ্যমের কাজও রয়েছে। শিল্পীরা দেশের ভূপ্রকৃতির রূপ-লাবণ্য নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কেউ এঁকেছেন পার্বত্য এলাকার ভূদৃশ্য—সাঙ্গু নদ; কেউ এঁকেছেন ফসলের মাঠ, সমুদ্রের বেলাভূমিতে সূর্যাস্ত, নদীতে মাছ ধরা, গ্রামীণ মেঠো পথ ধরে ফসল নিয়ে চলতে থাকা মহিষের গাড়ি, সাঁওতাল গ্রাম, মহেশখালীর নৌকার ঘাট, বেদের বহর, পাখি, মাছ, গাছপালা—এমন নয়নাভিরাম বহু দৃশ্য।
পুরান ঢাকার রূপলাল হাউস, কার্জন হল, বিরুলিয়ার জমিদারবাড়ি, পানাম নগরের প্রাচীন প্রাসাদ—এসবও এসেছে অনেকের কাজে। এর পাশাপাশি সমকালীন বিষয়েও দৃষ্টিপাত করেছেন শিল্পীরা। করোনাকালের লকডাউন এসেছে তাঁদের কাজে, অনেকে এঁকেছেন আধা বিমূর্ত রীতিতে।
বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে আছে কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা পাখি ও সূর্য, সমরজিৎ রায়চৌধুরীর বান্দরবানের পাহাড়ি দৃশ্য, হাশেম খানের পাখপাখালির কূজনমুখর ভোরবেলা। রফিকুন নবী এঁকেছেন মায়ের সঙ্গে দুই ছানা পাখি। মনিরুল ইসলামের বিমূর্ত রীতির কম্পোজিশন, হামিদুজ্জামান খানের নারীর মুখ, শাহাবুদ্দিন আহমদের ধাবমান মানুষ।
একটু ভিন্ন ধাঁচে জলরঙে পাখি এঁকেছেন আবদুশ শাকুর, বীরেন সোম প্যাস্টেল ও কলমের রেখায় এঁকেছেন নারী ও পাখি। অলকেশ ঘোষ জলরঙে এঁকেছেন বান্দরবানের পাহাড়ের সারির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সাঙ্গু নদের বিস্তৃত দৃশ্য।
ফরিদা জামান এঁকেছেন নারীর মাছ ধরা, শিশির ভট্টাচার্য্য কালি–কলমে রেখাচিত্র, জামাল আহমেদ এঁকেছেন নদীতীরে জেলে পরিবারের জাল টেনে নেওয়ার ছবি। সূর্যাস্ত এঁকেছেন রণজিৎ দাশ। গৌতম চক্রবর্তী হাতি এঁকেছেন জলরঙে, সোহাগ পারভেজ জলরঙে তুলে এনেছেন নিসর্গ দৃশ্য।
সব মিলিয়ে এই প্রদর্শনীতে খ্যাতনামা ও নবীন প্রজন্মের শিল্পীদের বিচিত্র ধরনের অনেক কাজ একসঙ্গে দেখার সুযোগ পাবেন দর্শকেরা, যে সুযোগ সচরাচর মেলে না।