‘সিটিসেল বন্ধে কী আসে যায়’

‘প্রিটি ওমেন’ সিনেমায় রিচার্ড গিয়ারের হাতে লম্বা একটি মোবাইল সেটের কথা পাঠকের হয়তো মনে আছে, সেটা ১৯৯০ সালের কথা। সারা পৃথিবীতেই সে ফোন দামি। শুধু ধনী ব্যক্তিদের হাতেই ফোনগুলো দেখা যেত।

বাংলাদেশেও ছিল সেরকম দেখতে মোবাইল সেট। সে সময়কার বেশি দামের সেই মোবাইল সেট শুধু অতিধনী ব্যক্তিরাই কিনতে পারতেন, নাম ছিল ‘সিটিসেল’।

বছর সাতেক আগেই সিটিসেল গুটিয়েছে। নিজের গ্রাহক চলে গেছে অন্যের দ্বারে। তবু নামমাত্র ছিল একটি লাইসেন্স, সেটিও বাতিল হলো। দেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর প্যাসিফিক টেলিকম বাংলাদেশ (সিটিসেল)-এ শেষ পেরেক মারার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সিটিসেল বন্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই খোদ কর্তৃপক্ষেরই। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করা মেহবুব চৌধুরী বলছেন, ‘সিটিসেল বন্ধে কিছুই আসে যায় না। লাইসেন্স থাকলেই কি, না থাকলেই কি। আর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলছেন, যে অপারেটরের অস্তিত্ব নেই, তার লাইসেন্স থাকা না থাকায় কী হবে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, সিটিসেলের অবশিষ্ট টুজি লাইসেন্স বাতিলের অনুমোদন হয়েছে। বকেয়া টাকা পরিশোধ না করায় বিটিআরসি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

যেভাবে এল সিটিসেল

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নব্বইয়ের দশকে দেশে একমাত্র মোবাইল সেবাদাতার ইতিহাস জানা যায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৮৯ সালে সিটিসেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। হংকংভিত্তিক হুটচিসন ও বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড যৌথভাবে সিটিসেল চালু করে। তারা অ্যানালগ মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করত। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই মোবাইল–সেবা সাধারণের জন্য ছিল না।

বিএনপি ক্ষমতায় এলে ১৯৯৩ সালে সিটিসেলের বর্তমানে ৫৫ ভাগ শেয়ারের মালিক হয় দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী প্যাসিফিক মোটরস ও ফার ইস্ট টেলিকম। এর মধ্যে প্যাসিফিক মোটরসের শেয়ারের পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আর ফারইস্ট টেলিকমের ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাকি ৪৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিংটেল। প্যাসিফিকের কর্ণধার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খান।

লাইসেন্স বাতিল নিয়ে প্রতিক্রিয়া

সিটিসেল গত বৃহস্পতিবার রাতে টুজি লাইসেন্স বাতিলের চিঠি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করা মেহবুব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটিসেল বন্ধে কিছুই আসে যায় না। লাইসেন্স থাকলেই কি, না থাকলেই কি। ব্যবসা তো আর এখন করা যাবে না।’ বকেয়া টাকার প্রসঙ্গে জানান, আদালতে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

সিটিসেল প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটিসেলের তরঙ্গও নেই। তারা ব্যবসা না করলে লাইসেন্স দিয়ে কী করবে।’

আরও পড়ুন

সিটিসেলের এই দশা যেভাবে হলো

১৯৯৬ সালের নভেম্বরে দেশের বর্তমান শীর্ষ অপারেটর গ্রামীণফোন লাইসেন্স নেওয়ার আগে সিটিসেল একচেটিয়া ব্যবসাই করছিল। সে সময়ে একটেল (রবি) ও সেবা (বাংলালিংক) লাইসেন্স নেয়।

প্রতিযোগী আসার আগে সিটিসেল শুধু ঢাকা মহানগরীকেন্দ্রিক সেবা দিত। গুটি কয়েক মানুষের হাতেই ছিল মোবাইলের ব্যবহার। ২০১৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) করা ‘গ্রামীণফোনের পারদর্শিতা মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৬ সালে টেলিযোগাযোগ সেবার দিক দিয়ে বিশ্বে পিছিয়ে থাকায় বাংলাদেশ ছিল ১৩ নম্বরে। এশিয়ায় বাংলাদেশ ছিল পেছনের দিক দিয়ে ৩ নম্বর। তখন প্রতি ১০০ জন মানুষের বিপরীতে বাংলাদেশে টেলিফোন লাইন ছিল শূন্য দশমিক ৩টি। ৭০ শতাংশ টেলিফোন লাইন ছিল চট্টগ্রাম, ঢাকা ও খুলনায়। দেশের অন্য অঞ্চলে প্রতি এক হাজার মানুষের বিপরীতে ছিল মাত্র একটি ফোন।

সে সময় সরকারি সংস্থা টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ডের (টিঅ্যান্ডটি নামে পরিচিতি) গ্রাহক ছিল সাড়ে তিন লাখের মতো। একমাত্র মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের গ্রাহক ছিল প্রায় ২০ হাজার।

সবার আগে ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ গ্রামীণফোন তাদের সেবা চালু করে। বিশেষ করে তাদের পল্লীফোন সেবা দেশের মোবাইল জগতে আমূল পরিবর্তন আনে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের দ্বারে পৌঁছে যায় মোবাইল–সেবা। বাজারের অন্য প্রতিযোগীরা নিজেদের নেটওয়ার্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। দেখাদেখি সিটিসেলও সে পথে হাঁটে। দেশে ইন্টারনেট–সেবা মানুষের নাগালে আসার সময়ে সিটিসেলের জুম ইন্টারনেট–সেবা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

সিটিসেল ছিল অ্যানালগ এবং অন্যরা ডিজিটাল প্রযুক্তির। তাই সিটিসেলের সেবার মান ভালো ছিল না। তাই তারা সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল একসেস) প্রযুক্তি নিয়ে আসে। এই প্রযুক্তি আবার যেকোনো মুঠোফোনে ব্যবহার করা যায় না। অর্থাৎ সিটিসেল গ্রাহকদের মোবাইলসহ সিম কিনতে হতো।

কিন্তু পুরো বিশ্ব তখন সিডিএমএ থেকে জিএসএম (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইলস) প্রযুক্তিতে ধাবিত হতে থাকে। এ ধরনের প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যেকোনো মুঠোফোনেই ব্যবহার করা যায়। বিশ্বের মুঠোফোনসেবা এখন জিএসএম প্রযুক্তিতেই চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে সিটিসেল সেই সিডিএমএতেই পড়ে থাকে। অন্যদের চেয়ে ধীরে ধীরে তারা প্রতিযোগিতায়ও পেছনের দিকে পড়ে যায়।

সিটিসেলের এই পরিণতির জন্য তাদের ব্যবসায়ীদের দূরদর্শিতার অভাবকেই দায়ী করেন লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক ও টেলিযোগাযোগ–বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এক প্রযুক্তিতে আটকে থেকে সিটিসেল নিজেদের গ্রাহকদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা বানিয়ে দেয়। তারা যদি সে সময় যুগের চাহিদা ও প্রযুক্তির চরিত্রের কথা চিন্তা করে জিএসএম প্রযুক্তিতে আসত, তাহলে আজকের অবস্থা হয়তো হতো না। বিখ্যাত কোম্পানি সিংটেলও তাদের অংশীদার হয়ে মালিকপক্ষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়। তাদের নানা রকম ফি–এর বোঝা বাড়তে থাকে, গ্রাহক কমে যায় ও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বাজারের অন্য প্রতিযোগীরা বিনিয়োগ পায়, ব্যবসা বড় করে ফেলে। নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণেই সিটিসেল আজ হারিয়ে গেল।

২০১৬ সালের আগস্ট থেকে সিটিসেল বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সে বছরের অক্টোবরে তরঙ্গ বন্ধ করে দিয়েছিল বিটিআরসি। ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিটিআরসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিটিসেলের গ্রাহক ছিল শূন্য দশমিক ১৪২ মিলিয়ন।
অন্যদিকে বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রামীণফোনের গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার (৭৯.৯৫ মিলিয়ন), রবির ৫ কোটি ৫১ লাখ ৪০ হাজার (৫৫.১৪ মিলিয়ন), বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮ লাখ ৫০ হাজার (৪০.৮৫ মিলিয়ন) ও রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের ৬৬ লাখ ৭০ হাজার (৬.৬৭ মিলিয়ন)।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সিটিসেলের বিষয়ে কাজ শুরু করে বিটিআরসি। তাদের কাছে বকেয়া ২০০ কোটি টাকার বেশি আদায় নিয়ে সিটিসেলকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, সিটিসেল যে জবাব দিয়েছিল, তা সন্তোষজনক না। তাদের টুজি লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে।

দেশের টেলিকম খাতে ধারাবাহিকভাবে লাভে আছে গ্রামীণফোন। গত অর্থবছরে তাদের ১৫ হাজার ৪০ দশমিক ৩৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। দ্বিতীয় অপারেটর রবি কখনো লাভে কখনো লোকসানে থাকে। বাংলালিংক এখনো সুবিধাজনক অবস্থায় যেতে পারেনি। এ ছাড়া সরকারি অপারেটর টেলিটক ২০০৫ সালে অনেক আশার বাণী শুনিয়ে এখন নিজেই ধুঁকছে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে তাদের দেনা পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি।

টেলিযোগাযোগ–বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে একটা জিনিস দেখা যায়, এখানে দেশি বিনিয়োগকারীরা সেবা খাতে ব্যর্থ। সিটিসেল এর অন্যতম উদাহরণ। দেশের যত বড় হোটেল তার কোনোটিতেই দেশীয় বিনিয়োগকারী মালিক নেই। মোবাইল খাতেও তাই। দেশের বিনিয়োগকারীরা সেবা খাতের চেয়ে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বেশি উৎসাহী।