মৃত্যুর পথে নৌকায় যাত্রা...আধুনিক দাসত্বের এই শিকল আজও অদৃশ্য

ছেলে সোহেলের ছবি হাতে মা হাসিনা আক্তারছবি: সামিনা রশ্নি

টেকনাফের করাচি পাড়া গ্রামে একচালা এক টিনের ঘরে ছেলে সোহেলকে নিয়ে বসবাস বিধবা হাসিনা আক্তারের। সেই ঘরটাই খাঁ খাঁ করছে এখন। চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে উন্নত জীবনের আশায় সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য নৌকায় ওঠেন সোহেল। এর পর থেকে ছেলের খোঁজ নেই, দিশাহারা মা হাসিনা আক্তারও। থানা, ম্যাজিস্ট্রেট অফিস দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই দিন শেষ তাঁর। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সরকার থেকে খবর দিছে ছেলে মালয়েশিয়ার কারাগারে বন্দি। একজনের কাছে শুনছি, খুব অসুস্থ। আল্লাহ আমার ছেলেটারে বাঁচাক। সব কাগজপত্র জমা দিলে পরে ওকে ফিরায় আনবে সরকার।’

শুধু সোহেল নয়, আধুনিক যুগের দাসত্বখ্যাত মানব পাচারের শিকার হয়ে খালি হচ্ছে হাজার হাজার মায়ের কোল। শিকার হচ্ছে পাশবিক নির্যাতনের, হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। কাউকে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে পানিতে, কেউবা মুক্তিপণের দাবিতে দালালদের অমানবিক নির্যাতন সইতে না পেরে ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে।

ঝুঁকি জেনেও কেন ও কারা যাত্রা করে?

উন্নত জীবন, ভাগ্যোন্নয়নে কিংবা পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে যেকোনো উপায়ে বিদেশ যেতে মরিয়া অনেকেই। গত এপ্রিলে ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে মিয়ানমার কারাগার থেকে দেশে ফিরিয়ে আনে সরকার। সেখানে ছিলেন মোহাম্মদ জামাল। এলাকায় ছোটখাটো একটি ব্যবসা করতেন। পরিচতজনের কাছে সেখানকার গল্প শুনে তাঁর মনেও স্বপ্ন জাগে মালয়েশিয়া যাবার। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার ১২ মাসের মাথায় স্বপ্নহারা জামালকে ফিরতে হয় দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে।

টেকনাফের মানিক মোল্লা, সাড়ে সাত বছর ধরে ছোট ভাই শাকিল মোল্লাকে খুঁজে ফিরছেন। মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে ১৭ বছরের শাকিল রঙিন স্বপ্ন নিয়ে জলে ভাসেন। এরপর আর পরিবারের কাছে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। পানিতে ডুবে মারা গেছে, নাকি কোনো দেশের পুলিশের অত্যাচার সইতে না পেরে হারিয়ে গেছে ভাইটি, জানেন না তিনি। মানিক মোল্লা বলেন, ‘সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল শাকিল। বছর দুয়েক আগে এক দালাল শাকিল মালয়েশিয়ার কারাগারে অমানবিক জীবন যাপন করছে বলে জানায়। সেই দালালকে বিশ্বাস করে টাকাপয়সা দিই। এরপর সে–ও গায়েব, ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই।’

উন্নত জীবনের আশায় সমুদ্রপথে যাত্রার এমন দৃশ্য বড়ই করুণ
ছবি: ইউএনএইচসিআর

মূলত তরুণ-কিশোররাই ‘টার্গেট’ হন। স্বপ্নপূরণ করতে তেমন একটা খরচ হবে না, লাখ টাকার মাইনের চাকরি—এমন সব প্রলোভন দেখায় স্থানীয় দালালরা। অর্থবৈভব আছে এমন নানা বয়সীদের বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া, এমনকি আমেরিকা নিউজিল্যান্ড পাঠানোর লোভও দেখানো হয়। নারীদের হোটেল-মোটেল, পারলার কিংবা শপিং মলে ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলা হয়।

অত্যাচারের ছবিটা বড়ই করুণ

কক্সবাজারের মোহাম্মদ জামাল। চার ভাইবোনের মধ্য সবার বড়। বাবার সঙ্গে ছোটখাটো একটি দোকান করতেন। আইয়ুব নামের এক দালালের প্ররোচনায় চার লাখ টাকা চুক্তিতে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনীয়া থেকে তাঁদের ১০ জনকে একটি ছোট্ট নৌকায় করে নিয়ে তোলা হয় জাহাজে, যা আসলে একটি মাছ ধরার ছোট ট্রলার। সেখানে ছিলেন সব মিলে ৭৩ জন। এর মধ্য পাঁচজন নারী ছিল, যারা ১৮ বছরের কম বয়সী।

জামাল বলেন, ‘তিন দিন ট্রলারে ভাসার পর আমাদের ট্রলারটা বার্মার সীমানায় গিয়ে তলা ফেটে যায়। এভাবে ছিলাম আমরা আরো দিন দুয়েক। এরপর ট্রলারে লাল কাপড় বেঁধে, ইচ্ছা করে আমরা বার্মার নৌবাহিনীর কাছে ধরা দিই। সেখানে যারা রোহিঙ্গা তাদের এবং বাংলাদেশিদের আলাদা কারাগারে রাখা হয়। আমরা ছিলাম মিও মিও টং জেলখানায়।’

মিয়ানমারের কারাগারে সব কাজ বাংলাদেশি বন্দীদের দিয়ে করানো হয়। জামাল বলেন, ‘সবজি চাষ থেকে শুরু করে রান্না সব করতে হতো, তবে খাবার জুটত সামান্য। সকাল সাতটার দিকে ভাতের মাড়, ১১টায় কিছু ভাত খেতে দিত, সঙ্গে থাকত শুকনা মরিচ, বিকেল চারটায় আরেকবার ভাত। মাছ, মাংসের চেহারাও দেখিনি। ১১ মাস ১৯ দিন কারাভোগের পর সরকারি সহযোগিতায় দেশে ফিরে আসি জুলাই মাসে। যারা নিজেদের বয়স ১৮ বছরের কম বলেছে, ওদের এখনো আটকে রেখেছে।’

টেকনাফের কামাল (ছদ্মনাম) মালয়েশিয়া যাবার জন্য আবু নামের একজনের সঙ্গে এক লাখ টাকার চুক্তি করেন। সেখানে গিয়ে ভালো চাকরি পাবার পর শোধ করার প্রতিশ্রুতিতে। সেই শুরু অসহনীয় যাত্রার। কামাল বলেন, ‘আমার মতো আরও অনেকের সঙ্গে রোহিঙ্গারাও ছিল ট্রলারে। একজন রোহিঙ্গা প্রতিবাদ করলে তাকে গুলি করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। ট্রলারটি প্রথমে মিয়ানমার সীমানার বঙ্গোপসাগরে পৌঁছায়, সাত দিন ছিলাম সেখানে। এরপর থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ার পথ ধরি আমরা। এর মধ্যেই তিন লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য চাপ দেয় দালালরা। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর সেখানকার পুলিশের ধাওয়ায় আমরা যাই ইন্দোনশিয়ার জলসীমানায়। সেখান থেকেও আমাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পাচারের শিকার রোহিঙ্গারা
ফাইল ছবি: এএফপি

মাঝে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে দুজন বাঙালি প্রাণ হারায়। এরপর রাগ করে বাঙালিরা ট্রলার ডুবিয়ে দেয়, পাশ দিয়ে অনেক জাহাজ গেলও আমাদের উদ্ধার করেনি। পরে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ আমাদের উদ্ধার করে। সেখানে ১১ মাস আটক থাকার পর বাংলাদেশ সরকার আমাদের ফিরিয়ে আনে।’

টানা তিন মাস সাগরে ভেসে থাকার সেই স্মৃতি আজও দুঃস্বপ্ন হয়ে ফেরে কামালের। বলেন, প্রতিদিন এক বেলায় জুটত সাদা ভাত-মরিচ আর এক গ্লাস পানি। সকালের এইটুকু খেয়েই ২৮ ঘণ্টা পার করতে হতো। মাঝে একবার এক গ্লাস পানি। খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে কেউ মারা গেলে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। খাবার বা পানি চাইলে মারধর করত। দালালেরা অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি পরিবারের কাছ থেকে আদায় করে টাকা। বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মোট খরচ হয় দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা।

ভুক্তভোগী কামাল বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার নামে এখন কান ধরি। সবাইকে বলি, কষ্ট করে বিদেশ না গিয়ে দেশেই কিছু করার চেষ্টা করেন।’

পাচারের শিকার বেশি রোহিঙ্গারা

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে ৮ হাজার ৩১২ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৮৯ জনের সলিলসমাধি হয়েছে। নিখোঁজও হয়েছেন অনেকে। রোহিঙ্গা নারী ২৮ বছর বয়সী সুফিয়ার বিয়ে ঠিক হয় মালয়েশিয়ার আরেক রোহিঙ্গার সঙ্গে। তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সুফিয়ার আত্মীয়ের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করে পাচারকারীরা। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি, দিনদুয়েক পর পানিশূন্যতায় মারা যান তিনি। সুফিয়ার মা বলেন, ‘টাকা জোগাড় করে দালালদের দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম, তখন নৌকা থেকেই একজন জানায় সুফিয়ার মৃত্যুর খবর।’

দালালদের গ্রেপ্তার, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু এবং ট্রলারডুবিতে মৃত্যু—কিছুই সমুদ্রপথে মানব পাচার রোধ করতে পারে বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা ‘অভিবাসন’ এবং ‘পাচারের’ মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তারা দালালদের পরামর্শ অনুযায়ী গোপন রাখার পরিবর্তে তাদের বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে স্বচ্ছ হওয়ার জন্য ব্যক্তিদের আহ্বান জানায়। মানুষকে বোঝানো যে মানব পাচার একটি বিপজ্জনক এবং অবৈধ কার্যকলাপ। সরকার, পরিবার এবং সামাজিক সংগঠনগুলিকে এই সমস্যা মোকাবেলায় একযোগে কাজ করতে হবে।