গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বাড়াতে হবে

প্রথম আলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: আগামীর ভাবনা’ শিরোনামে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। সিপিডি পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি ইউনিট এই আয়োজনে সহযোগিতা করে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সাবেক সদস্যসচিব, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালে তৎকালীন সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পেট্রোবাংলার গ্যাসক্ষেত্রগুলো কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল। পরবর্তীকালে, এমনকি এখনো সরকার এটাকে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করে। বর্তমান সরকার কিন্তু বিগত ১৪ বছরে তার বিপরীত কাজটি করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জাতীয় মালিকানা থেকে এটি ক্রমান্বয়ে ব্যবসা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি কোম্পানির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি আশির দশক থেকে শুরু হয়।

জ্বালানি সম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জ্বালানি নিরাপত্তা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এটি এখন হুমকির মুখে। যেসব প্রকল্প পুরো দেশকে বিপন্ন করবে বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বড় ধরনের বিপদের মধ্যে ফেলবে, তাকে উন্নয়ন বলা যায় না। যে প্রকল্পের মাধ্যমে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, ভবিষ্যতে আমি অধিকতর নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারব, অধিকতর দক্ষ হতে পারব, অধিকতর অবদান রাখতে পারব, এ ধরনের প্রকল্পগুলোকে আমি উন্নয়ন প্রকল্প বলব।

বিশ্ব বর্তমানে জ্বালানি খাতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। তারা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকছে। যখন সারা বিশ্ব ছেড়ে দিচ্ছে, তখন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বাংলাদেশ নিজেদের পায়ে কুঠার মারার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে অনেক বড় আকারের অর্থ ব্যয় হয়েছে। আর্থিকভাবে চিন্তা করলে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের জনবহুল জায়গা, সুন্দরবনের মতো জায়গা, নদীর পাড়ে, উপকূলজুড়ে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রয়েছে, এসব স্থানে যে প্রকল্প করা হয়েছে, তা বাংলাদেশকে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে ফেলতে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বাড়বে। দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ওপর এর ভয়াবহ একটি প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশে এই যে ধারাটি তৈরি হয়েছে, তা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। এটি ধারাবাহিকভাবে ও পরিকল্পিতভাবে হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের মূল যুক্তি হচ্ছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যদি বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করা হয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ সংযুক্ত করা হয়, তাহলে অপচয় কমবে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দামও কমবে। এটি অনেক বেশি ব্যবহারকারীবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব হবে। এটি পুরোটাই ভুল। এর বিপরীত চিত্র আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি। এখানে বেসরকারি মালিকদের যত যুক্ত করা হয়েছে, যত বিদেশি কোম্পানি আনা হয়েছে, তত আমাদের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সুতরাং যদি আর্থিকভাবেও চিন্তা করি, তাহলেও বোঝা যাচ্ছে এটি ভুল একটি রাস্তা। এই রাস্তা তৈরির সুবিধাভোগী আছে অনেক। গত দেড় দশকে ১২ থেকে ১৩টি কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে এক লাখ কোটি টাকা নিয়েছে। আমাদের উৎপাদনের তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ। তারপরও আমরা কিন্তু বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। গরমকালে ঢাকা শহরে আমার বাসায় প্রতিদিন তিন থেকে চারবার করে লোডশেডিং হয়। ঢাকার বাইরে সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং হয়।

বাংলাদেশের শক্তির জায়গাটা হচ্ছে আমাদের স্থলভাগে এবং সমুদ্রে গ্যাস সম্পদ আছে। কাজেই আগামী কয়েক দশক পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া দরকার। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ ও কম ব্যয়বহুল। সমুদ্র ও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব দিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রেও আমাদের সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও বর্জ্যশক্তিকে কাজে লাগানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এ তিনটি খাতকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নত করতে হবে, সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য কয়লা, তেল বা পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজন নেই। আমাদের আমদানিনির্ভর ও ঋণনির্ভর প্রকল্প করার প্রয়োজন নেই। আমরা জাতীয় সক্ষমতা দাঁড় করাতে পারি দুইভাবে। একটি হচ্ছে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন। অন্যটি হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো। এ দুইয়ের সম্মিলনে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই নিরাপদ, সুলভ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।

(সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৭ অক্টোবর ২০২৩)