এ আঘাত বাংলাদেশের ওপর

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তার প্রতিবাদে ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত গণমাধ্যম, আক্রান্ত বাংলাদেশ’ ব্যানারে মানববন্ধন করে সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব। এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সংগঠন, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ অংশ নেন। গতকাল রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনেছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসীদের হামলা-আগুন, লুটপাট এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতিকে হেনস্তার ঘটনা শুধু গণমাধ্যমের ওপর হামলা নয়, এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের ওপরও আঘাত করা হয়েছে। এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। তাই গণতন্ত্রমনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধকে হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে এই অপশক্তিকে রুখে দিতে হবে।

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক যৌথ প্রতিবাদ সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়া এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ ও মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (নোয়াব) এর আয়োজন করে। গতকাল সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ সভা হয়। প্রতিবাদ সভা শেষে সোনারগাঁও হোটেলের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

অত্যন্ত পরিষ্কার, এখানে কোনো কথা বলার কিছু নেই। আজকে ডেইলি স্টার নয়, প্রথম আলো নয়, আজকে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত এসেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম মহাসচিব, বিএনপি

প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনে সংহতি জানাতে আসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বক্তাদের অনেকেই ছায়ানট ভবন ও উদীচী কার্যালয়ে হামলারও প্রতিবাদ জানান।

বক্তারা বলেন, এসব হামলার ঘটনা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। এটা নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র।

গত বৃহস্পতিবার রাতে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত হামলার শিকার হয় দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো। হামলাকারীরা ভাঙচুর ও লুটপাটের পর কার্যালয়ে আগুন দেয়। একই রাতে ডেইলি স্টার কার্যালয়েও ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুন দেওয়া হয়। সে সময় সাংবাদিকদের রক্ষায় ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গেলে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীরকে হেনস্তা করা হয়। এ ঘটনাকে ‘গণমাধ্যমের জন্য কালো দিন’ আখ্যায়িত করে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছেন অনেকেই।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল যৌথ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব।

‘এটা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত’

প্রতিবাদ সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তিনি খুবই অসুস্থ। তারপরও এসেছেন তাঁর বিশ্বাস ও হৃদয়ের টানে। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, এই মুহূর্তে কোন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আছি? আমার বয়স ৭৮ বছর। সারা জীবন সংগ্রাম করেছি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখব বলে। আজ যে বাংলাদেশ দেখছি, এ বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি কোনো দিন দেখিনি।’

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব এই সভার আয়োজন করে। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে সোমবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, ‘অত্যন্ত পরিষ্কার, এখানে কোনো কথা বলার কিছু নেই। আজকে ডেইলি স্টার নয়, প্রথম আলো নয়, আজকে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত এসেছে। আমার স্বাধীনভাবে চিন্তা করার যে অধিকার, আমার কথা বলার যে অধিকার, তার ওপর আবার আঘাত এসেছে। জুলাই যুদ্ধের ওপর আঘাত এসেছে। কারণ, জুলাই যুদ্ধ ছিল এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। আজকে সেই জায়গায় আঘাত এসেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমার অনুরোধ কোনো রাজনৈতিক দল-সংগঠন নয়, সব গণতন্ত্রকামী মানুষের এখন এক হওয়ার সময় এসেছে। আমরা যাঁরা অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে চাই, আমরা যাঁরা বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটা স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্রী বাংলাদেশ দেখতে চাই, আজকে তাঁদের শুধু সচেতন নয়, রুখে দাঁড়ানোর সময় এসে গেছে। আমি আহ্বান জানাব শুধু একাত্মতা ও সংহতি নয়, সর্বশক্তি দিয়ে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন, এই অপশক্তিকে রুখে দিতে হবে।’

মতের পার্থক্য যদি আমরা টলারেট (সহ্য) করতে না পারি, তাহলে কিন্তু সামনের দিনে আমাদের আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মাহবুবুর রহমান ব্যবসায়ী নেতা
‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক যৌথ প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সোমবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব এই সভার আয়োজন করে
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এ হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে সরকারের ভেতরের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্লোগানগুলো ব্যবহার করে তারা সেখানে আক্রমণ করেছে এবং সেটার পক্ষে সম্মতি তৈরি করেছে। এ ঘটনার পরে আমরা বলেছি যে সরকারের ভেতরের একটা অংশের এখানে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সমাজে এটার পক্ষে সম্মতি তৈরি করা হয়েছিল অনেক দিন ধরেই এবং এটার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যাকআপও আছে। এই তিনটা ঘটনা একসঙ্গে না ঘটলে এত বড় সাহস সেই রাতে কারও পক্ষে করা সম্ভব হতো না।’

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে ‘গভীর ষড়যন্ত্র জড়িত’ বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। তিনি বলেন, ‘আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ভন্ডুল করার জন্য, প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এ ধরনের একটি চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এ হামলার বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমরা দেখলাম, সরকার এ ক্ষেত্রে রহস্যজনকভাবে নীরব। সরকারের এই রহস্যজনক নীরবতার অর্থ কী?’ হামলার সময় সেখানে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

যাঁরা গণমাধ্যমে কাজ করেন, তাঁদের ভয় দেখানো হয়েছে। এ ঘটনায় কারা উসকানি দিয়েছেন, তা তদন্ত করে বের করার দায়িত্ব সরকারের।
আইরিন খান জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার

‘পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা’

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ‘মধ্যযুগীয় কায়দায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা’ বলে মন্তব্য করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর। তিনি বলেন, যখন সংবাদকর্মীরা কাজ করছেন, তখন পত্রিকা অফিসের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিয়ে এবং ফায়ার সার্ভিসের আসার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য পরিষ্কার হয়েছে। তারা চেয়েছে মধ্যযুগীয় কায়দায় চারপাশ থেকে আগুন লাগিয়ে যাঁদের সঙ্গে তাদের মতান্তর তৈরি হয়, তাঁদের পুড়িয়ে হত্যা করা। এসব হামলা সহ্য করা হলে সমাজের উন্নতির সমস্ত পথ রুদ্ধ হবে।

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়া এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে সোমবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে প্রতিবাদ সমাবেশে
ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে পত্রিকা দুটির সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াতে (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) দেখা গেছে যে তারা (হামলাকারী) বলছে, ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর যারা সাংবাদিক, তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যা করতে হবে।’ একে ‘নৃশংস’ উল্লেখ করে মতপ্রকাশের বাইরে গিয়ে এখন সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন এসেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মানবজমিন–এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী সংহতি জানাতে আসা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকব, আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হবই। এটা এক দিনের যুদ্ধ নয়, অনেক দিন যুদ্ধ চলবে।’

‘এভাবে চললে দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না’

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, পরমতসহিষ্ণুতা গড়ে না উঠলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারবে না। বরং সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হতে পারে। সব সরকারের সময়ই দেশে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত আসে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মতের পার্থক্য যদি আমরা টলারেট (সহ্য) করতে না পারি, তাহলে কিন্তু সামনের দিনে আমাদের আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক যৌথ প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান। সোমবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব এই সভার আয়োজন করে
ছবি: প্রথম আলো

মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কারও মুখপাত্র নয়। কোনো দল বা মতের পক্ষে নয়, তারা স্বাধীন সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছে এবং করছে।

বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে কিন্তু এখন একটা জিনিসই চাই, আমাদের জানমালের নিরাপত্তা দেন। অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও তার মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর—এটাই আমাদের দাবি।’

সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না ছায়ানট কবে কী রাজনীতি করল? ঠিক তেমনি বুঝতে পারি না, নূরুল কবীর ভাই কবে ফ্যাসিস্টের সহযোগী হলেন, আমি কিন্তু জানি না। আমি ঠিক তেমনভাবে জানি না যে আমার প্রিয় মতি ভাই (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) কবে কখন কার দালালি করলেন, মাহফুজ ভাই (ডেইলি স্টার সম্পাদক) নিজে কখন শেখ হাসিনার সহযোগী হলেন, এগুলো বড় প্রশ্ন।’

অভ্যন্তরীণ নানা সংকট থেকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তৈরি হয়। আজকে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এসে গেছে।
ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

‘সরকার বৈধতা অনেক ক্ষেত্রেই হ্রাস করে ফেলেছে’

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘এটা আমাদের ফ্রিডম অব স্পিচের (বাক্স্বাধীনতা) ওপরে শুধু না, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুর ওপরে আঘাত এসেছে। ছায়ানট কেন ভ্যান্ডালাইজ করা হলো? প্রশ্নটা রাখছি বর্তমান সরকারের কাছে।’ এ ছাড়া সাম্প্রতিক কালে বাউল এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলার প্রসঙ্গ তুলে একে ‘অরাজকতা’ বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সোমবার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে
ছবি: প্রথম আলো

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একটি অনির্বাচিত সরকারের শাসন করার যোগ্যতা-ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ তার নৈতিক বৈধতা থাকে। এ ঘটনার ভেতর দিয়ে বর্তমান সরকার তার বৈধতা অনেক ক্ষেত্রেই হ্রাস করে ফেলেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অভ্যন্তরীণ নানা সংকট থেকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তৈরি হয়। আজকে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এসে গেছে।

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক। সোমবার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে
ছবি: প্রথম আলো

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সাবেক প্রধান নারীনেত্রী শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘শুভবুদ্ধি মনে হয় দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছে। তারপরও আমরা কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছি। আমাদের লড়তে হবে। শুধু প্রতিবাদ করলে হবে না।...সেদিন যা ঘটনা ঘটেছে, সেটা একটা ভয়াবহ ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু তারপরে সরকারের যে নিষ্ক্রিয়তা, সেটা ভয়ংকর।’

প্রকৌশলী শামসুল ওয়ারেস বলেন, ‘মবক্রেসি’ কোনো সভ্য জগতে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেভাবে হোক, যতভাবেই হোক, এটা প্রতিরোধ করতে হবে।

ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়ার সময় সেখানে আটকে পড়েন সংবাদমাধ্যমটির কর্মীরা। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই মূল দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। এখানে আমাদের অধিকার রক্ষা করা, জীবন-জীবিকা রক্ষা করা, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে সে দায়িত্বটা তাদের।’ ঘটনার সময় সরকারের দায়িত্বশীল কেউ কেন আসেননি, এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘লাখ লাখ তরুণ বের হচ্ছে চাকরি ছাড়া, স্বপ্ন ছাড়া।...একটা সংকটময় সময় পার করছি। এই সমস্যাগুলো সমাধানে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, সেখানে একটা কৃত্রিম সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। এই “কালচারাল ওয়ার”–এর শেষ নেই।’

‘রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ওপর আঘাত’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, গণমাধ্যম হচ্ছে গণতন্ত্রের চোখ। সরকার একেবারে ভেতর থেকে রাষ্ট্রকে দেখতে পারে গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে। এই গণমাধ্যমের ওপর আঘাত মানে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। এই গণমাধ্যমের ওপর আঘাত মানে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ওপর আঘাত।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া বলেন, এই আঘাত বাঙালি জাতিসত্তার ওপর আঘাত, সংস্কৃতির ওপর আঘাত।

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর। সোমবার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে
ছবি: প্রথম আলো

সাংবাদিকদের ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য দেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম। বক্তব্য দেন ইআরএফের সভাপতি দৌলত আক্তার মালা।

‘ভয় দেখানো হয়েছে’

জনরোষকে একটি অস্ত্র বানিয়ে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান।

জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়া এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে সোমবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে প্রতিবাদ সমাবেশে
ছবি: প্রথম আলো

তিনি বলেন, এর মাধ্যমে যাঁরা গণমাধ্যমে কাজ করেন, তাঁদের ভয় দেখানো হয়েছে। এ ঘটনায় কারা উসকানি দিয়েছে, তা তদন্ত করে বের করার দায়িত্ব সরকারের। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তিনি।

সাংবাদিক মহাসম্মেলনের ঘোষণা

প্রতিবাদ সভায় সংহতি জানাতে আসা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, প্রতিবাদ সভায় সবাই একটা কথাই সাধারণভাবে বলেছেন, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যাবে না। সেই লক্ষ্যে আপনাদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা সারা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের নিয়ে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে একটা সাংবাদিক মহাসম্মেলন করব। সেখান থেকে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব।’

সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াবের  ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক  যৌথ প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ। সোমবার দুপুরে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

এ কে আজাদ বলেন, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীতে যারা আগুন দিয়েছে, তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এবং সাংবাদিকেরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম হয়তো আশঙ্কা করেছিলেন, প্রথম আলোতে হামলার পর ডেইলি স্টার–এরও হামলা হতে পারে। তাই সে সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভিন্ন ব্যক্তিকে ডেইলি স্টার–এর সামনে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ওই সময় সাহায্য-সাড়া পাননি। যখন পেয়েছেন (সহায়তা), পোড়ার পর পেয়েছেন।

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সভায় সংহতি জানাতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী মীর নাসির হোসেন, আলমগীর কবীর, ফজলুল হক, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, নিহাদ কবীর, কামরান টি রহমান, আহসান খান চৌধুরী, সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মঈনুল ইসলাম, তাসকীন আহমেদ, রিজওয়ান রাহমান, প্রীতি চক্রবর্তী, নাসের এজাজ বিজয় প্রমুখ। আরও এসেছিলেন সারওয়ার আলী, রামেন্দু মজুমদার, শহিদুল আলম, সাইফুল হক, অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, এম মাসরুর রিয়াজ প্রমুখ।

মানববন্ধন

প্রতিবাদ সভা শেষে সোনারগাঁও হোটেলের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন হয়। সেখানে প্রতিবাদ সভায় অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও অংশ নেন আবুল খায়ের, মোস্তাফিজুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমদ, রেহনুমা আহমেদ, মতিউর রহমান, কামাল আহমেদ, এস এম শহীদুল্লাহ খান, আলতামাশ কবীর, শাহেদ মুহাম্মদ আলী, কামরুল হাসান, ইনাম আহমেদ, আশা মেহরীন আমিন, রিয়াজ আহমেদ, শাহরিয়ার কবীর, রেজাউল করিম, ইফতেখার মাহমুদ, মোরছালীন বাবলা, সিদ্দিকুর রহমান খান প্রমুখ।